প্রাণী
প্রাণী
: ১৯৬
وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ ۚ فَإِنْ أُحْصِرْتُمْ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ ۖ وَلَا تَحْلِقُوا رُءُوسَكُمْ حَتَّىٰ يَبْلُغَ الْهَدْيُ مَحِلَّهُ ۚ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ بِهِ أَذًى مِنْ رَأْسِهِ فَفِدْيَةٌ مِنْ صِيَامٍ أَوْ صَدَقَةٍ أَوْ نُسُكٍ ۚ فَإِذَا أَمِنْتُمْ فَمَنْ تَمَتَّعَ بِالْعُمْرَةِ إِلَى الْحَجِّ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ ۚ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ فِي الْحَجِّ وَسَبْعَةٍ إِذَا رَجَعْتُمْ ۗ تِلْكَ عَشَرَةٌ كَامِلَةٌ ۗ ذَٰلِكَ لِمَنْ لَمْ يَكُنْ أَهْلُهُ حَاضِرِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

আর তোমরা হজ ও ‘উমরা পূর্ণ কর [১] আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে। অতঃপর যদি তোমরা বাঁধা প্রাপ্ত হও তাহলে সহজলভ্য হাদঈ [২] প্রদান করো। আর তোমরা মাথা মুণ্ডন করো না [৩], যে পর্যন্ত হাদঈ তার স্থানে না পৌছে। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কেউ অসুস্থ হয় বা মাথায় কষ্টদায়ক কিছু হয় তবে সিয়াম কিংবা সাদাকা অথবা পশু যবেহ দ্বারা তার ফিদ্‌ইয়া দিবে [৪]। অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে কেউ উমরাকে হজের সঙ্গে মিলিয়ে লাভবান হতে চায় [৫] সে সহজলভ্য হাদঈ যবাই করবে। কিন্তু যদি কেউ তা না পায়, তবে তাকে হজের সময় তিন দিন এবং ঘরে ফিরার পর সাত দিন এ পূর্ণ দশ দিন সিয়াম পালন করতে হবে। এটা তাদের জন্য, যাদের পরিজনবর্গ মসজিদুল হারামের বাসিন্দা নয়। আর তোমরা আল্লাহ্‌র তাকওয়া অবলম্বন কর এবং জেনে রাখ যে, নিশ্চয় আল্লাহ্‌ শাস্তি দানে কঠোর [৬]

ফুটনোট

[১] হজ সর্বসম্মতভাবে ইসলামের আরকানসমূহের মধ্যে একটি রুকন এবং ইসলামের ফরযসমূহ বা অবশ্যকরণীয় বিষয়সমূহের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ফরয। কুরআনের বহু আয়াত এবং অসংখ্য হাদীসের মাধ্যমে এর প্রতি তাকিদ ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

[২] হাদঈ বলতে এমন জানোয়ার বুঝায় যা মীকাতের বাইরের লোকদের মধ্য থেকে যারা হজ ও উমরা একই সফরে আদায় করবে, তাদের উপর আল্লাহ্‌র জন্য যবেহু করা ওয়াজিব হয়। যার রক্ত হারাম এলাকায় পড়তে হয়। মনে রাখাতে হবে যে, তা সাধারণ কুরবানী নয়।

[৩] আয়াতে মাথা মুণ্ডনকে ইহরাম ভঙ্গ করার নিদর্শন বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয় যে, ইহরাম অবস্থায় চুল ছাঁটা বা কাটা অথবা মাথা মুণ্ডন করা নিষিদ্ধ।

[৪] যদি কোন অসুস্থতার দরুন মাথা বা শরীরের অন্য কোন স্থানের চুল কাটতে হয় অথবা
মাথায় উকুন হওয়াতে বিশেষ কষ্ট পায়, তবে এমতাবস্থায় মাথার চুল বা শরীরের অন্য কোন স্থানের লোম কাটা জায়েয। কিন্তু এর ফিদইয়া বা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর তা হচ্ছে সাওম পালন করা বা সদকা দেয়া বা যবেহ্ করা। ফিদইয়া যবেহ করার জন্য হারামের সীমারেখা নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু সাওম পালন বা সদকা দেয়ার জন্য কোন বিশেষ স্থান নির্ধারিত নেই। তা যে কোন স্থানে আদায় করা চলে। কুরআনের শব্দের মধ্যে সাওমের কোন সংখ্যা নির্ধারিত নেই এবং সদকারও কোন পরিমাণ নির্দেশ করা হয়নি। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী কাব ইবনে উজরার এমনি অবস্থার প্রেক্ষিতে এরশাদ করেছেনঃ ‘তিন দিন সাওম অথবা ছয়জন মিসকীনকে খাবার দাও, প্রত্যেক মিসকীনকে মাথাপিছু অর্ধ সা’ খাবার দাও এবং তোমার মাথা মুণ্ডন করে ফেল'। [বুখারীঃ ৪৫১৭]

[৫] হজের মাসে হজের সাথে উমরাকে একত্রিকরণের দু'টি পদ্ধতি রয়েছে। একটি হচ্ছে, মীকাত হতে হজ ও উমরাহর জন্য একত্রে এহ্‌রাম করা। শরীআতের পরিভাষায় একে ‘হজে-কেরান’ বলা হয়। এর এহ্‌রাম হজের এহ্‌রামের সাথেই ছাড়তে হবে, হজের শেষদিন পর্যন্ত তাকে এহ্‌রাম অবস্থায়ই কাটাতে হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, মীকাত হতে শুধু উমরার এহরাম করবে। মক্কায় আগমনের পর উমরার কাজ-কর্ম শেষ করে এহ্‌রাম খুলবে এবং ৮ই জিলহজ তারিখে মীনা যাওয়ার প্রাক্কালে স্ব স্ব স্থান থেকে এহ্‌রাম বেঁধে নেবে। শরীআতের পরিভাষায় একে ‘হজে-তামাতু’ বলা হয়।

[৬] আয়াতটিতে প্রথমে তাকওয়া অবলম্বন করার আদেশ দেয়া হয়েছে; যার অর্থ এসব নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত, সতর্ক ও ভীত থাকা বুঝায়। যে ব্যক্তি জেনে-বুঝে আল্লাহ্‌র নির্দেশাবলীর বিরুদ্ধাচরণ করে, তার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। আজকাল হজ্ব ও উমরাকারীগণের অধিকাংশই এ সম্পর্কে অসতর্ক। তারা প্রথমতঃ হজ্ব ও উমরার নিয়মাবলী জানতেই চেষ্টা করে না। আর যদিওবা জেনে নেয়, অনেকেই তা যথাযথভাবে পালন করে না। অনেকে ওয়াজিবও পরিত্যাগ করে। আর সুন্নাত ও মুস্তাহাবের তো কথাই নেই। আল্লাহ্‌ সবাইকে নিজ নিজ আমল যথাযথভাবে পালন করার তৌফিক দান করুন।

: ২০৫
وَإِذَا تَوَلَّىٰ سَعَىٰ فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا وَيُهْلِكَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْفَسَادَ

আর যখন সে প্রস্থান করে তখন সে যমীনে অশান্তি সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত্র ও প্রাণী ধ্বংসের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ্‌ ফাসাদ ভালবাসেন না।
ফুটনোট

:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ ۚ أُحِلَّتْ لَكُمْ بَهِيمَةُ الْأَنْعَامِ إِلَّا مَا يُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ وَأَنْتُمْ حُرُمٌ ۗ إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ مَا يُرِيدُ

হে মুমিনগণ [১] ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ [২] পূর্ণ করবে [৩]। যা তোমাদের নিকট বর্ণিত হচ্ছে [৪] তা ছাড়া গৃহপালিত [৫] চতুষ্পদ জন্তু [৬] তোমাদের জন্য হালাল করা হল, তবে ইহরাম অবস্থায় শিকার করাকে বৈধ মনে করবে না [৭]। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা ইচ্ছে আদেশ করেন [৮]।

ফুটনোট

সূরা সংক্রান্ত আলোচনাঃ

আয়াত সংখ্যাঃ ১২০

নামকরণঃ এ সূরারই ১১২ ও ১১৬ নং আয়াতদ্বয়ে উল্লেখিত “মায়েদাহ” শব্দ থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। মায়েদা শব্দের অর্থঃ খাবারপূর্ণ পাত্র।

সূরা নাযিলের প্রেক্ষাপটঃ সূরা আল-মায়েদাহ সর্বসম্মত মতে মাদানী সূরা। মদীনায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের মধ্যেও এটি শেষ দিকের সূরা। এমনকি, কেউ কেউ একে কুরআন মজীদের সর্বশেষ সূরাও বলেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা ও আসমা বিনতে ইয়াযীদ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত আছে, সূরা আল-মায়েদাহ যে সময় নাযিল হয়, সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে ‘আদ্ববা’ নামীয় উষ্ট্রীর পিঠে সওয়ার ছিলেন। সাধারণতঃ ওহী অবতরণের সময় যেরূপ অসাধারণ ওজন ও বোঝা অনুভূত হতো, তখনও যথারীতি তা অনুভূত হয়েছিল। এমনকি ওজনের চাপে উষ্ট্রী অক্ষম হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীচে নেমে আসেন। [মুসনাদে আহমাদঃ ৬/৪৫৫] কোন কোন বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, এটি ছিল বিদায় হজ্জের সফর। বিদায় হজ্জ নবম হিজরীর ঘটনা। এ হজ্জ থেকে ফিরে আসার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় আশি দিন জীবিত ছিলেন। আবু হাইয়ান বলেনঃ সূরা মায়েদার কিয়দাংশ হোদায়বিয়ার সফরে, কিয়দাংশ মক্কা বিজয়ের সফরে এবং কিয়দাংশ বিদায় হজ্জের সফরে নাযিল হয়। এতে বোঝা যায় যে, এ সূরাটি সর্বশেষ সূরা না হলেও শেষ পর্যায়ে অবতীর্ণ হয়েছে। [বাহরে মুহীত]

জুবায়ের ইবনে নুফায়ের থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি একবার হজ্জের পর আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে উপস্থিত হলে তিনি বললেনঃ জুবায়ের, তুমি কি সূরা মায়েদাহ পাঠ কর? তিনি আরয করলেন, জী-হ্যাঁ, পাঠ করি। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, এটি কুরআনুল কারীমের সর্বশেষ সূরা। এতে হালাল ও হারামের যেসব বিধি-বিধান বর্ণিত আছে, তা অটল। এগুলো রহিত হওয়ার নয়। কাজেই এগুলোর প্রতি বিশেষ যত্নবান থেকো। [দেখুনঃ মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৩১১]

রহমান, রহীম আল্লাহর নামে

[১] আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন শুনবে যে, আল্লাহ্ তা’আলা ‘ইয়া আইয়ুহাল্লায়ীনা আমানু’ বা ‘হে ঈমানদারগণ’ বলছে তখন সেটাকে কান লাগিয়ে শুন। কেননা, এর মাধ্যমে কোন কল্যানের নির্দেশ আসবে বা অকল্যাণ থেকে নিষেধ করা হবে। [ইবন কাসীর]

[২] আয়াতে মুমিনগণকে ওয়াদা-অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ কারণেই সূরা মায়েদার অপর নাম সূরা ‘উকুদ তথা ওয়াদা- অঙ্গীকারের সূরা। চুক্তি-অঙ্গীকার ও লেন-দেনের ক্ষেত্রে এ সূরাটি বিশেষ করে এর প্রথম আয়াতটি সবিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমর ইবন হায্‌মকে ঐ আমলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে প্রেরণ করেন এবং একটি ফরমান লিখে তাঁর হাতে অর্পণ করেন, তখন এ ফরমানের শিরোনামে উল্লেখিত আয়াতটিও লিপিবদ্ধ করে দেন। [দেখুন, নাসায়ী: ৪৮৫৬; আল খাতীবুল বাগদাদী, আল ফাকীহ ওয়াল মুতাফাককিহ হাদীস নং ৩১৮ (হাদীসটির সনদ হাসান); দেখুন, ‘আদেল ইউসুফ আল-‘আয্‌যাযীর টিকা এবং ইরউয়াউল গালীল ১ম খণ্ড: পৃষ্ঠা নং ১৫৮-১৬১]

[৩] (عُقُوْدٌ) শব্দটি (عقد) শব্দের বহুবচন। এর শাব্দিক অর্থ বাঁধা, আবদ্ধ করা। চুক্তিতে যেহেতু দুই ব্যক্তি অথবা দুই দল আবদ্ধ হয়, এজন্য এটাকেও (عقد) বলা হয়েছে। এভাবে (عُقُوْدٌ) এর অর্থ হয়-(عهود) অর্থাৎ চুক্তি ও অঙ্গীকার। [তাবারী] বস্তুত: দুই পক্ষ যদি ভবিষ্যতে কোন কাজ করা অথবা না করার বাধ্য-বাধকতায় একমত হয়ে যায়, তবে তাকেই আমরা আমাদের পরিভাষায় চুক্তি বলে অভিহিত করে থাকি। অতএব, উপরোক্ত বাক্যের সারমর্ম এই যে, পারস্পরিক চুক্তি পূর্ণ করাকে জরুরী ও অপরিহার্য মনে কর। [আহকামুল কুরআন লিল জাসসাস]

তবে এ আয়াতে চুক্তি বলে কোন্‌ ধরনের চুক্তিকে বুঝানো হয়েছে এ ব্যাপারে তফসীরবিদগণের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের কাছ থেকে ঈমান ও ইবাদত সম্পর্কিত যে সব অঙ্গীকার নিয়েছেন অথবা আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের কাছ থেকে স্বীয় নাযিলকৃত বিধি-বিধান হালাল ও হারাম সম্পর্কিত যেসব অঙ্গীকার নিয়েছেন, আয়াতে সেগুলোকেই বুঝানো হয়েছে। তাফসীরকার যায়দ ইবনে আসলাম বলেনঃ এখানে ঐসব চুক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যা মানুষ পরস্পরে একে অন্যের সাথে সম্পাদন করে। যেমন, বিবাহ-শাদী ও ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি ইত্যাদি। মুজাহিদ, রবী, কাতাদা প্রমুখ বলেনঃ এখানে ঐসব শপথ ও অঙ্গীকারকে বুঝানো হয়েছে যা জাহেলিয়াত যুগে একজন অন্যজনের কাছ থেকে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে সম্পাদন করতো। [বাগভী]

প্রকৃতপক্ষে এ সব উক্তির মধ্যে কোন বিরোধিতা নাই। কারণ, উপরোক্ত সব চুক্তি ও অঙ্গীকারই (عُقُوْدٌ) শব্দের অন্তর্ভুক্ত এবং কুরআন সবগুলোই পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছে। ইমাম আবুল লাইস আস-সামরিকান্দী বলেনঃ চুক্তির যত প্রকার রয়েছে, সবই এ শব্দের অন্তর্ভুক্ত। তিনি আরো বলেনঃ এর প্রাথমিক প্রকার তিনটি। (এক) পালনকর্তার সাথে মানুষের অঙ্গীকার। উদাহরণতঃ ঈমান ও ইবাদতের অঙ্গীকার অথবা হারাম ও হালাল মেনে চলার অঙ্গীকার। (দুই) নিজের সাথে মানুষের অঙ্গীকার। যেমন, নিজ যিম্মায় কোন বস্তুর মান্নত মানা অথবা শপথ করে কোন কাজ নিজের উপর জরুরী করে নেওয়া। (তিন) মানুষের সাথে মানুষের সম্পাদিত চুক্তি। এছাড়া সে সব চুক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত, যা দুই ব্যক্তি, দুই দল বা দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পাদিত হয়। বিভিন্ন সরকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি অথবা পারস্পরিক সমঝোতা, বিভিন্ন দলের পারস্পরিক অঙ্গীকার এবং দুই ব্যক্তির মধ্যকার সর্বপ্রকার লেন-দেন,বিবাহ, ব্যবসা, শেয়ার, ইজারা ইত্যাদিতে পারস্পরিক সম্মতিক্রমে যে সব বৈধ শর্ত স্থির করা হয়, আলোচ্য আয়াতদৃষ্টে তা মেনে চলা প্রত্যেক পক্ষের অবশ্য কর্তব্য। তবে শরী’আত বিরোধী শর্ত আরোপ করা এবং তা গ্রহণ করা কারও জন্যে বৈধ নয়। [তাফসীর আবুল লাইস আস-সামারকান্দী]

[৪] ‘যা বর্ণিত হচ্ছে’ বলে যা বোঝানো হয়েছে, তা এখানে বর্ণিত হয় নি। পরবর্তী ৩ নং আয়াতে সেটার বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। [আদওয়াউল বায়ান]

[৫] আয়াতে বর্ণিত (انعام) শব্দটি (نعم) -এর বহুবচন। এর অর্থ পালিত পশু। যেমন- উট, গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি। সূরা আল-আন’আমে এদের আটটি প্রকার বর্ণনা করা হয়েছে। এদের সবাইকে (نعم) বলা হয়। এখন আয়াতের অর্থ দাঁড়িয়েছে এই যে, গৃহপালিত পশু আট প্রকার তোমাদের জন্যে হালাল করা হয়েছে। পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, (عقود) শব্দ বলে যাবতীয় চুক্তি-অঙ্গীকার বুঝানো হয়েছে। তন্মধ্যে একটি ছিল ঐ অঙ্গীকার, যা আল্লাহ তা’আলা হালাল ও হারাম মেনে চলার ব্যাপারে বান্দার কাছ থেকে নিয়েছেন। আলোচ্য বাক্যে এই বিশেষ অঙ্গীকারটিই বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্যে উট, ছাগল ,গরু, মহিষ ইত্যাদিকে হালাল করে দিয়েছেন। শরীআতের নিয়ম অনুযায়ী তোমরা এগুলোকে যবেহ করে খেতে পার। [কুরতুবী]

[৬] এখানে সব ধরনের জন্তু বুঝানো হয়নি। বরং সুনির্দিষ্ট কিছু জন্তু বোঝানো হয়েছে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে (بَهِيْمَةٌ) যেসব জীব-জন্তুকে সাধারণভাবে নিবোধ মনে করা হয়, সেগুলোকে (بَهِيْمَةٌ) বলা হয়। কেননা, মানুষ অভ্যাসগতভাবে তাদের ভাষা বুঝে না। ফলে তাদের বক্তব্য (مُبْهَم) তথা অস্পষ্ট থেকে যায়। এখানে ‘বাহীমা’ বলে কোন কোন সাহাবীর মতে, জবাইকৃত প্রাণীর উদরে যে বাচ্ছা পাওয়া যায় সেটাকে বোঝানো হয়েছে। [তাফসীরে কুরতুবী; সাদী, বাগভী; ফাতহুল কাদীর]

[৭] ইহরাম অবস্থায় শিকার করতে নিষেধ করার মাধ্যমে এটাও উদ্দেশ্য হতে পারে যে, পূর্বে বর্ণিত ‘বাহীমাতুল আন’আম’ বলতে সে সমস্ত প্রাণীকেও বোঝাবে, যেগুলোকে সাধারণত শিকার করা হয়। যেমন, হরিণ, বন্য গরু, খরগোশ ইত্যাদি। কারণ, ইহরাম অবস্থায় শিকার করা হারাম হওয়ার অর্থ স্বাভাবিক অবস্থায় হালাল হওয়া। [সা’দী]

[৮] আল্লাহ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী একচ্ছত্র শাসক। তিনি নিজের ইচ্ছেমত যেকোন হুকুম দেয়ার পূর্ণ ইখতিয়ার রাখেন। কাতাদা বলেন, তিনি তাঁর সৃষ্টির ব্যাপারে যা ইচ্ছে বিধান প্রদানের অধিকারী। তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য যা ইচ্ছা তা বর্ণনা করেন, ফরয নির্ধারিত করেন, সীমা ঠিক করে দেন। আনুগত্যের নির্দেশ দেন ও অবাধ্যতা থেকে নিষেধ করেন। [আত-তাফসীরুস সহীহ] তাঁর সমস্ত বিধান জ্ঞান, প্রজ্ঞা, যুক্তি, ন্যায়-নীতি ও কল্যাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও ঈমানদার শুধু এ জন্যই তার আনুগত্য করে না; বরং একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহর হুকুম বলেই তাঁর আনুগত্য করে। তাই কোন বস্তুর হালাল ও হারাম হবার জন্য আল্লাহর অনুমোদন ও অননুমোদন ছাড়া আর দ্বিতীয় ভিত্তির আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। তারপরও সেগুলোতে অনেক হেকমত নিহিত থাকে। যেমন তোমাদেরকে তিনি অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন, কারণ, এতে রয়েছে তোমাদের স্বার্থ। আর এর বিপরীত হলে, তোমাদের স্বার্থহানী হবে। তোমাদের জন্য কিছু প্রাণী হালাল করেছেন সম্পূর্ণ দয়ার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। আবার কিছু প্রাণী থেকে নিষেধ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে মুক্ত রাখার জন্য। অনুরূপভাবে তোমাদের জন্য ইহরাম অবস্থায় শিকার করা নিষেধ করেছেন, তার সম্মান রক্ষার্থে। [সা’দী]


:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُحِلُّوا شَعَائِرَ اللَّهِ وَلَا الشَّهْرَ الْحَرَامَ وَلَا الْهَدْيَ وَلَا الْقَلَائِدَ وَلَا آمِّينَ الْبَيْتَ الْحَرَامَ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنْ رَبِّهِمْ وَرِضْوَانًا ۚ وَإِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوا ۚ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ أَنْ صَدُّوكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَنْ تَعْتَدُوا ۘ وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ ۖ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিদর্শনসমূহ [১], পবিত্র মাস, কুরবানীর জন্য কা’বায় পাঠানো পশু, গলায় পরান চিহ্নবিশিষ্ট পশু এবং নিজ রব-এর অনুগ্রহ ও সন্তোষলাভের আশায় পবিত্র ঘর অভিমুখে যাত্রীদেরকে বৈধ মনে করবে না [২]। আর যখন তোমরা ইহরামমুক্ত হবে তখন শিকার করতে পার [৩]। তোমাদেরকে মস্‌জিদুল হালামে প্রবেশে বাঁধা দেয়ার কারণে কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনই সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে [৪]। নেককাজ ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে [৫] এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ হে মুমিনগন, আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অবমাননা করো না। এখানে (شَعَائِر) শব্দটি - (شَعِيْرَةٌ) শব্দের বহুবচন। এর অর্থ, চিহ্ন। যেসব অনুভূত ও প্রত্যক্ষ ক্রিয়াকর্মকে সাধারণের পরিভাষায় মুসলিম হওয়ার চিহ্নরূপে গণ্য করা হয়, সেগুলোকে (شَعَائِرُ الاسْلام) তথা ‘ইসলামের নিদর্শনাবলী’ বলা হয়। যেমন, সালাত, আযান, হজ, দাড়ী ইত্যাদি। অনুরূপভাবে সাফা, মারওয়া, হাদঈ ও কুরবানীর জন্তু ইত্যাদিও আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত। [আত-তাফসীরুস সহীহ] আয়াতে উল্লেখিত ‘আল্লাহর নিদর্শনাবলী’র ব্যাখ্যা বিভিন্ন ভাবে বর্ণিত আছে। সব উক্তির নির্যাস হলো এই যে, আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অর্থ সব শরীআত এবং ধর্মের নির্ধারিত ফরয, ওয়াজিব ও এদের সীমা। [ফাতহুল কাদীর]

আলোচ্য আয়াতের সারমর্ম এই যে, আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অবমাননা করো না। আল্লাহর নিদর্শনাবলীর এক অবমাননা হচ্ছে, প্রথমতঃ এসব বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে চলা। দ্বিতীয়তঃ এসব বিধি-বিধানকে অসম্পূর্ণভাবে পালন করা এবং তৃতীয়তঃ নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া। আয়াতে এ তিন প্রকার অবমাননাকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। [সা’দী] আল্লাহ তা’আলা এ নির্দেশটিই অন্যস্থানে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, তা অন্তরের তাকওয়ারই লক্ষণ”। [সূরা আল-হাজ: ৩২] তাছাড়া আয়াতের বাকী অংশে এ নিদর্শণাবলীর কিছু বিবরণ প্রদান করা হয়েছে।

[২] অর্থাৎ পবিত্র মাসসমূহে যুদ্ধ-বিগ্রহ করে এগুলোর অবমাননা করো না। [আততাফসীরুস সহীহ] পবিত্র মাস হচ্ছে জিলকদ, জিলহজ, মুহাররাম ও রজব। এসব মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ করা শরীআতের আইনে অবৈধ ছিল। অধিকাংশ আলেমের মতে পরবর্তী কালে এ নির্দেশ রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু প্রখ্যাত তাবেয়ী ইমাম আতা, শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ এবং ইবনুল কাইয়্যেম মনে করেন যে, এ আদেশ রহিত হয় নি। যদি কেউ আক্রমণ করে বা যুদ্ধ এর আগে থেকেই চলে আসে তবে এ মাসে যুদ্ধ করা যাবে, নতুবা নয়। [সা’দী, ইবন কাসীর]

এ আয়াতে পরবর্তী নির্দেশ হচ্ছে, কুরবানী করার জন্তু, বিশেষতঃ যেসব জন্তুকে গলায় কুরবানীর চিহ্নস্বরূপ কিছু পরানো হয়েছে, সেগুলোর অবমাননা করো না। এসব জন্তুর অবমাননার এক পন্থা হচ্ছে এদের হারাম পর্যন্ত পৌছতে না দেয়া অথবা ছিনিয়ে নেয়া। দ্বিতীয় পন্থা এই যে, এগুলো কুরবানীর পরিবর্তে অন্য কোন কাজে নিয়োজিত করা। আয়াত এসব পস্থাকেই অবৈধ করে দিয়েছে। আয়াতে আরও বলা হয়েছে যে, তোমরা ঐসব লোকেরও অবমাননা করো না, যারা হজের জন্যে পবিত্র মসজিদের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করেছে। এ সফরে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বীয় পালনকর্তার রহমত, দয়া ও সন্তুষ্টি অর্জন করা। অর্থাৎ পথিমধ্যে তাদের গতিরোধ করো না এবং তাদের কোনরূপ কষ্ট দিয়ো না। [সা’দী]

[৩] এখানে ইহরাম অবস্থায় শিকার করতে যে নিষেধ করা হয়েছিল, সে নিষেধাজ্ঞার সীমা বর্ণনা করা হয়েছে যে, যখন তোমরা ইহরাম থেকে মুক্ত হয়ে যাও, তখন শিকার করার নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়ে যাবে। অতএব, তখন শিকারও করতে পারবে। [সা’দী]

[৪] অর্থাৎ যে সম্প্রদায় হুদায়বিয়ার ঘটনার সময় তোমাদের মক্কায় প্রবেশ করতে এবং ওমরা পালন করতে বাধা প্রদান করেছিল এবং তোমরা তীব্র ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এসেছিলে, এখন শক্তি-সামর্থ্যের অধিকারী হয়ে তোমরা তাদের কাছ থেকে এভাবে প্রতিশোধ নিও না যে, তোমরা তাদের কাবাগৃহে ও পবিত্র মসজিদে প্রবেশ করতে এবং হজ্জ করতে বাধা দিতে শুরু করবে। এটাই হবে যুলুম। আর ইসলাম যুলুমের উত্তরে যুলুম করতে চায় না। বরং ইসলাম যুলুমের প্রতিদানে ইনসাফ এবং ইনসাফে কায়েম থাকার শিক্ষা দেয়। এটাই প্রমাণ করে যে, ইসলাম হক দ্বীন। [আদওয়াউল বায়ান]

[৫] আলোচ্য আয়াতে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার ভিত্তি কি হবে সেটা আলোচনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন সৎকর্ম ও আল্লাহর ভয়কে আসল মাপকাঠি করেছে, এর ভিত্তিতেই পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার আহবান জানিয়েছে। এর বিপরীতে পাপ ও অত্যাচার উৎপীড়নকে কঠোর অপরাধ গণ্য করেছে এবং এতে সাহায্যসহযোগিতা করতে নিষেধ করেছে। মূলতঃ সৎকর্ম ও তাকওয়াই হলো শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। কারণ, সমস্ত মানুষ এক পিতা-মাতার সন্তান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিদায় হজ্জের ভাষণে ঘোষণা করেন যে, ‘কোন আরবের অনারবের উপর অথবা কোন শ্বেতাঙ্গের কৃষ্ণাঙ্গের উপর কোন শ্রেষ্ঠত্ব নাই। আল্লাহ ভীতি ও আল্লাহর আনুগত্যই শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি।’ [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৪১১]

আয়াতে বর্ণিত সৎকাজ ও পাপকাজ এর সংজ্ঞায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বির বা সৎকাজ হচ্ছে, সচ্চরিত্ৰতা। আর পাপ হচ্ছে, যা তোমার অন্তরে উদিত হয় অথচ তুমি চাও না যে, মানুষ সেটা জানুক’। [মুসলিম: ২৫৫৩]

অপর হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বি’র বা সৎকাজ হচ্ছে, যাতে অন্তর শান্ত হয়, চিত্তে প্রশান্তি লাভ হয়। আর পাপ হচ্ছে, যাতে অন্তরে শান্ত হয় না এবং চিত্তেও প্রশান্তি লাভ হয় না, যদিও ফতোয়াপ্রদানকারীরা তোমাকে ফতোয়া দিয়ে থাকুক’। [মুসনাদে আহমাদ ৪/১৯৪]

আর সহযোগিতার ধরণ সম্পর্কেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে অত্যাচারী হোক বা অত্যাচারিত’। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! অত্যাচারিতকে তো আমরা সাহায্য করে থাকি। কিন্তু অত্যাচারীকে কিভাবে সাহায্য করব? রাসূল বললেন, ‘তার দু’হাতে ধরে রাখবে’। [বুখারী: ২৪৪৪]

অপর হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে কেউ কোন মুসলিমের সম্মান-ইজ্জত-আব্রু নষ্ট হওয়া প্রতিরোধ করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার মুখমণ্ডল থেকে জাহান্নামের আগুন প্রতিরোধ করবেন। [তিরমিয়ী: ১৯৩১; মুসনাদে আহমাদ ৬/৪৫০] তাকওয়া ও বির এর মধ্যে পার্থক্য করে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নির্দেশিত বিষয় করার নাম বির, আর নিষেধকৃত বিষয় থেকে বেঁচে থাকার নাম তাকওয়া। [তাবারী]

:
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلَامِ ۚ ذَٰلِكُمْ فِسْقٌ ۗ الْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ ۚ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ۚ فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِإِثْمٍ ۙ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু [১], রক্ত [২], শূকরের গোস্ত [৩], আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে যবেহ করা পশু [৪], গলা চিপে মারা যাওয়া জন্তু [৫], প্রহারে মারা যাওয়া জন্তু [৬], উপর থেকে পড়ে মারা যাওয়া জন্তু [৭], অন্য প্রাণীর শিং এর আঘাতে মারা যাওয়া জন্তু [৮] এবং হিংস্র পশুতে খাওয়া জন্তু [৯]; তবে যা তোমরা যবেহ করতে পেরেছ তা ছাড়া [১০], আর যা মূর্তি পূজার বেদীর উপর বলী দেয়া হয় তা [১১] এবং জুয়ার তীর দিয়ে ভাগ্য নির্ণয় করা [১২], এসব পাপ কাজ। আজ কাফেররা তোমাদের দ্বীনের বিরুদ্ধাচরণে হতাশ হয়েছে [১৩]; কাজেই তাদেরকে ভয় করো না এবং আমাকেই ভয় কর। আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম [১৪], আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম [১৫]। অতঃপর কেউ পাপের দিকে না ঝুঁকে ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হলে তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

ফুটনোট

[১] আলোচ্য আয়াতে কয়েকটি জিনিস হারাম করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। তন্মধ্যে প্রথম হারাম বস্তু হিসেবে বলা হয়েছে, মৃত জিনিস। এখানে ‘মৃত’ বলে ঐ জন্তু বুঝানো হয়েছে, যা যবেহ্ ব্যতীত কোন রোগে অথবা স্বাভাবিকভাবে মরে যায়। এধরনের মৃত জন্তুর গোস্ত চিকিৎসা-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও মানুষের জন্যে ক্ষতিকর। তবে হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই প্রকার মৃতকে এ বিধানের বাইরে রেখেছেন, একটি মৃত মাছ ও অপরটি মৃত টিড্ডী। [মুসনাদে আহমদঃ ২/৯৭, ইবন মাজাহঃ ৩৩১৪]

[২] আয়াতে বর্ণিত দ্বিতীয় হারাম বস্তু হচ্ছে রক্ত কুরআনের অন্য আয়াতে (اَوْ دَمًا مَّسْفُوْحًا) বা ‘প্রবাহিত রক্ত’ [সূরা আল-আন’আম: ১৪৫] বলায় বুঝা যায় যে, যে রক্ত প্রবাহিত হয়, তাই হারাম। সুতরাং কলিজা ও প্লীহা রক্ত হওয়া সত্ত্বেও হারাম নয়। পূর্বোক্ত যে হাদীসে মাছ ও টিভভীর কথা বলা হয়েছে, তাতেই কলিজা ও প্লীহা হালাল হওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

[৩] আয়াতে বর্ণিত তৃতীয় হারাম বস্তু হচ্ছে, শুকরের গোস্ত। গোস্ত বলে তার সম্পূর্ণ দেহ বুঝানো হয়েছে। চর্বি ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত। [ইবন কাসীর]

[৪] আয়াতে বর্ণিত চতুর্থ হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু যা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়। যদি যবেহ্ করার সময়ও অন্যের নাম নেয়া হয়, তবে তা খোলাখুলি শির্ক। এরূপ জন্তু সর্বসম্মতভাবে মৃতের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আরবের মুশরেকরা মূর্তিদের নামে যবেহ করত। বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে কোন কোন মুর্খ লোক পীর-ফকীরের নামে যবেহ করে। যদিও যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে; কিন্তু জন্তুটি যেহেতু অন্যের নামে উৎসর্গীকৃত এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্যে জবেহ বা কুরবানী করা হয়, তাই এ সব জন্তুও আয়াত দৃষ্টে হারাম।

[৫] আয়াতে বর্ণিত পঞ্চম হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু যাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে অথবা নিজেই কোন জাল ইত্যাদিতে আবদ্ধ অবস্থায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে গেছে। [ইবন কাসীর]

[৬] আয়াতে বর্ণিত ষষ্ঠ হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু, যা লাঠি অথবা পাথর ইত্যাদির প্রচন্ড আঘাতে নিহত হয়। যদি নিক্ষিপ্ত তীরের ধারাল অংশ শিকারের গায়ে না লাগে এবং তীরের আঘাতে শিকার নিহত হয়, তবে সে শিকারও এর অন্তর্ভুক্ত এবং হারাম। [ইবন কাসীর]

[৭] আয়াতে বর্ণিত সপ্তম হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু, যা কোন পাহাড়, টিলা, উচু দালানের উপর থেকে অথবা কুপে পড়ে মরে যায়। এমনিভাবে কোন পাখিকে তীর নিক্ষেপ করার পর যদি সেটি পানিতে পড়ে যায়, তবে তা খাওয়াও নিষিদ্ধ। কারণ, এখানেও পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। [ইবন কাসীর]

[৮] আয়াতে বর্ণিত অষ্টম হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু, যা কোন সংঘর্ষে নিহত হয়। যেমন রেলগাড়ী, মোটর ইত্যাদির নীচে এসে মরে যায় অথবা কোন জন্তুর শিং-এর আঘাতে মরে যায়। [ইবন কাসীর]

[৯] আয়াতে বর্ণিত নবম হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু, যেটি কোন হিংস জন্তুর কামড়ে মরে যায়। [ইবন কাসীর] এগুলো ছাড়াও হাদীসে অন্যান্য আরো কয়েক ধরনের প্রাণী হারাম করা হয়েছে।

[১০] উপরোক্ত নয় প্রকার হারাম জন্তুর বর্ণনা করার পর একটি ব্যতিক্রম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, (اِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ) অর্থাৎ এসব জন্তুর মধ্যে কোনটিকে জীবিত অবস্থায় পাওয়ার পর যবেহ করতে পারলে হালাল হয়ে যাবে। এ ব্যতিক্রম প্রথমোক্ত চার প্রকার জন্তুর সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে না। কেননা, মৃত ও রক্তকে যবেহ্ করার সম্ভাবনা নাই এবং শূকর এবং আল্লাহ ব্যতিত অন্যের নামে উৎসর্গীকৃত জন্তু সত্তার দিক দিয়েই হারাম। এ দুটোকে যাবেহ্ করা না করা উভয়ই সমান। এ কারণে আলেমগণ এ বিষয়ে একমত যে, এ ব্যতিক্রম প্রথমোক্ত চারটি পরবতী পাঁচটির সাথে সম্পর্কযুক্ত। অতএব আয়াতের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, শেষোক্ত এ পাঁচ প্রকার জন্তুর মধ্যে যদি জীবনের স্পন্দন অনুভব করা যায় এবং তদবস্থায়ই বিসমিল্লাহ বলে যবেহ করে দেয়া হয়, তবে এগুলো খাওয়া হালাল হবে। [ইবনে কাসীর]

[১১] আয়াতে বর্ণিত দশম হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু, যাকে নুছুবের উপর যবেহ্ করা হয়। নুছুব ঐ প্রস্তর বা বেদীকে বলা হয়, যা কাবা গৃহের আশেপাশে স্থাপিত ছিল। জাহেলিয়াত যুগে আরবরা এদের উপাসনা করত এবং এদের উদ্দেশ্যে জন্তু কোরবানী করত। একে তারা ইবাদত বলে গণ্য করত। জাহেলিয়াত যুগের আরবরা উপরোক্ত সব প্রকার জন্তুর গোস্ত ভক্ষণে অভ্যস্ত ছিল। আল্লাহ তা’আলা এগুলোকে হারাম করেছেন। [ইবন কাসীর] বর্তমানেও যদি কোথাও আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও জন্য উৎসর্গ করার কোন বেদী বা কবর অথবা এ জাতীয় কিছু থাকে এবং সেখানে কেউ কোন কিছু যবেহ করে, তবে তাও হারাম হবে।

[১২] আয়াতে উল্লেখিত একাদশ হারাম বস্তুটি হচ্ছে, ইস্তেকসাম বিল আযলাম । যার অর্থ তীরের দ্বারা বন্টণকৃত বস্তু। (اَزْلَامٌ) শব্দটি (زَلَمٌ) এর বহুবচন। এর অর্থ ঐ তীর, যা জাহেলিয়াত যুগে ভাগ্য পরীক্ষার জন্যে নির্ধারিত ছিল। এ কাজের জন্যে সাতটি তীর ছিল। তন্মধ্যে একটিতে (نعم) (হ্যাঁ), একটিতে (لا) (না) এবং অন্যগুলোতে অন্য শব্দ লিখিত ছিল। এ তীরগুলো কা’বাগৃহের খাদেমের কাছে থাকত। কেউ নিজ ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইলে অথবা কোন কাজ করার পূর্বে তা উপকারী হবে না অপকারী, তা জানতে চাইলে সে কাবার খাদেমের কাছে পৌঁছে একশত মুদ্রা উপটৌকন দিত। খাদেম তুন থেকে একটি একটি করে তীর বের করত। ‘হ্যাঁ’ শব্দ বিশিষ্ট তীর বের হয়ে আসলে মনে করা হত যে, কাজটি উপকারী। পক্ষান্তরে ‘না’ শব্দ বিশিষ্ট তীর বের হলে তারা বুঝে নিত যে, কাজটি করা ঠিক হবে না। হারাম জন্তুসমূহের বর্ণনা প্রসঙ্গে এ বিষয়টি উল্লেখ করার কারণ এই যে, তারা এ তীরগুলো জন্তুসমূহের গোস্ত বন্টনেও ব্যবহার করত। কয়েকজন শরীক হয়ে উট ইত্যাদি যবেহ করে তা গোস্ত প্রাপ্য অংশ অনুযায়ী বন্টন না করে এসব জুয়ার তীরের সাহায্যে বন্টন করত। ফলে কেউ সম্পূর্ণ বঞ্চিত, কেউ প্রাপ্য অংশের চাইতে কম এবং কেউ অনেক বেশী গোস্ত পেয়ে যেত। এ কারণে হারাম জন্তুর বর্ণনা প্রসঙ্গে এ হারাম বন্টন পদ্ধতিও বর্ণনা করা হয়েছে। [ইবন কাসীর] আলেমগণ বলেন, ভবিষ্যৎ অবস্থা এবং অদৃশ্য বিষয় জানার যেসব পস্থা প্রচলিত আছে; যেমন ভবিষ্যৎ কথন বিদ্যা, হস্তরেখা বিদ্যা, ইত্যাদি সব (اسْتِقْسَام بِالْاَزْلَامِ) এর অন্তর্ভুক্ত এবং হারাম। (اسْتِقْسَام بِالْاَزْلَامِ) শব্দটি কখনও জুয়া অর্থেও ব্যবহৃত হয়, যাতে গুটিকা নিক্ষেপ অথবা লটারীর নিয়মে অধিকার নির্ধারণ করা হয়। আল্লাহ তা’আলা একে (مَيْسر) নাম দিয়ে হারাম ও নিষিদ্ধ করেছে। মোটকথা এ জাতীয় বস্তু দ্বারা কোন কিছু নির্ধারণ করা হারাম। [ফাতহুল কাদীর]

[১৩] অর্থাৎ অদ্য কাফেররা তোমাদের দ্বীনকে পরাভূত করার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে। কাজেই তোমরা তাদেরকে আর ভয় করো না। তবে আল্লাহকে ভয় কর। এ আয়াতাংশ যখন নাযিল হয়, তখন মক্কা এবং প্রায় সমগ্র আরব মুসলিমদের করতলগত ছিল। সমগ্র আরব উপত্যকায় ইসলামী বিধি-বিধান প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। তাই বলা হয়েছেঃ ইতিপূর্বে কাফেররা মুসলিমদের সংখ্যা ও শক্তি অপেক্ষাকৃত কম দেখে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার পরিকল্পনা করতো। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে এরূপ দুঃসাহস ও বল-ভরসা নাই। এ কারণে মুসলিমরা তাদের পক্ষ থেকে নিশ্চিত হয়ে স্বীয় রবের আনুগত্য ও ইবাদতে মনোনিবেশ করুক। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আরব উপদ্বীপে মুসল্লীরা শয়তানের ইবাদত করবে এ ব্যাপারে সে নিরাশ হয়েছে, তবে সে তাদের মধ্যে গণ্ডগোল লাগিয়ে রাখতে পারবে”। [বুখারী: ১১৬২; আবু দাউদ: ১৫৩৮; তিরমিযী ৪৮০; ইবন মাজাহঃ ১৩৮৩] কোন কোন মুফাসসির বলেন, কাফেরদের নিরাশ হওয়ার অর্থ, তারা তোমাদের মত হবে এবং তোমাদের কর্মকাণ্ড তাদের মত হবে এ ব্যাপারে তারা নিরাশ হয়েছে, কারণ, তোমাদের গুণাগুণ তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। [ইবনে কাসীর]

[১৪] দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দেবার অর্থই হচ্ছে এর মধ্যে জীবনের সমস্ত প্রশ্নের নীতিগত ও বিস্তারিত জবাব পাওয়া যায়। হেদায়াত ও পথনির্দেশ লাভ করার জন্য এখন আর কোন অবস্থায়ই তার বাইরে যাবার প্রয়োজন নাই। সুতরাং এ নবীর পরে কোন নবী নেই। এ শরীআতের পরে কোন শরীআত নেই। এ শরীআতে যা যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে সত্য ও ইনসাফপূর্ণ। আল্লাহ বলেন, “সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার রব-এর বাণী পরিপূর্ণ। তার বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নেই”। [সূরা আল-আন’আম: ১১৫] [ইবন কাসীর]

[১৫] আয়াতের এ অংশটি নাযিলের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। আরাফার দিন। এ দিনটি পূর্ণ বৎসরের মধ্যে সর্বোত্তম দিন। ঘটনাক্রমে এ দিনটি পড়েছিল শুক্রবারে। এর শ্ৰেষ্ঠত্বও সর্বজনবিদিত। স্থানটি হচ্ছে ময়দানে-আরাফাত। এ স্থানটিই আরাফার দিনে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত নাযিল হওয়ার বিশেষ স্থান। সময় আছরের পর-যা সাধারণ দিনগুলোতেও বরকতময় সময়। বিশেষতঃ শুক্রবার দিনে। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, এ দিনের এ সময়েই দো'আ কবুলের মূহুর্তটি ঘনিয়ে আসে। আরাফার দিনে আরও বেশী বৈশিষ্ট্য সহকারে দোআ কবুলের সময়। হজ্জের জন্যে মুসলিমদের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ ঐতিহাসিক সমাবেশ। প্রায় দেড় লক্ষ সাহাবায়ে-কেরাম উপস্থিত। রাহমাতুল্লিল-আলামীন সাহাবায়ে-কেরামের সাথে আরাফার সে বিখ্যাত পাহাড়ের নীচে স্বীয় উষ্ট্রী আদ্ববার পিঠে সওয়ার। সবাই হজ্জের প্রধান রোকন অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে অবস্থানরত। এসব শ্রেষ্ঠত্ব, বরকত ও রহমতের ছত্রছায়ায় উল্লেখিত পবিত্র আয়াতটি নাযিল হয়। [দেখুন, তিরমিযীঃ ৩০৪৪]

আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ এ আয়াত কুরআনের শেষ দিকের আয়াত। এরপর বিধি-বিধান সম্পর্কিত আর কোন আয়াত নাযিল হয়নি। বলা হয় যে, শুধু উৎসাহ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শনমূলক কয়েকখানি আয়াত-এর পর নাযিল হয়েছে। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র একাশি দিন পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন। কেননা, দশম হিজরীর ৯ই যিলহজ্জ তারিখে এ আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং একাদশ হিজরীর ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাত পান। [ইবন কাসীর]

:
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا أُحِلَّ لَهُمْ ۖ قُلْ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ ۙ وَمَا عَلَّمْتُمْ مِنَ الْجَوَارِحِ مُكَلِّبِينَ تُعَلِّمُونَهُنَّ مِمَّا عَلَّمَكُمُ اللَّهُ ۖ فَكُلُوا مِمَّا أَمْسَكْنَ عَلَيْكُمْ وَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهِ ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ

মানুষ আপনাকে প্রশ্ন করে, তাদের জন্য কি কি হালাল করা হয়েছে? বলুন, ‘তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে সমস্ত পবিত্র জিনিস [১]। আর শিকারী পশু-পাখি, যাদেরকে তোমরা শিকার শিখিয়েছ – আল্লাহ তোমাদেরকে যা শিখিয়েছেন তা থেকে সেগুলোকে তোমরা শিখিয়ে থাক –সুতরাং এই (শিকারী পশুপাখি)-গুলো যা কিছু তোমাদের জন্য ধরে আনে তা থেকে খাও। আর এতে আল্লাহর নাম স্মরণ কর [২] এবং আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রুত হিসেব গ্রহণকারী’।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে বর্ণিত (طيبات) শব্দের তিনটি অর্থ হয়ে থাকে। এক. যাবতীয় রুচিসম্পন্ন। দুই. যাবতীয় হালালকৃত। তিন. যাবতীয় যবাইকৃত প্রাণী। কারণ, যবাই করার কারণে সেগুলোতে পরিচ্ছন্নতা এসেছে। [ফাতহুল কাদীর]

[২] আয়াতে শিকারী কুকুর, বাজ ইত্যাদি দ্বারা শিকার করা জন্তু হালাল হওয়ার জন্যে কয়েকটি শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম শর্তঃ কুকুর অথবা বাজ শিক্ষাপ্রাপ্ত হতে হবে। শিকার পদ্ধতি এই যে, আপনি যখন কুকুরকে শিকারের দিকে প্রেরণ করবেন, তখন সে শিকার ধরে আপনার কাছে নিয়ে আসবে- নিজে খাওয়া শুরু করবে না। বাজপাখীর বেলায় পদ্ধতি এই যে, আপনি ফেরৎ আসার জন্যে ডাক দেয়া মাত্রই সে কাল বিলম্ব না করে ফিরে আসবে- যদিও তখন কোন শিকারের পিছনে ধাওয়া করতে থাকে। শিকারী জন্তু এমনভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে গেলে বোঝা যাবে যে, সে আপনার জন্যে শিকার করে, নিজের জন্যে নয়। এমতাবস্থায় এগুলোর ধরে আনা শিকার স্বয়ং আপনারই শিকার বলে গন্য হবে। যদি শিকারী জন্তু কোন সময় এ শিক্ষার বিরুদ্ধাচরণ করে যেমন, কুকুর নিজেই খাওয়া আরম্ভ করে কিংবা বাজপাখী আপনার ডাকে ফেরৎ না আসে, তবে এ শিকার আপনার শিকার নয়। কাজেই তা খাওয়াও বৈধ নয়। দ্বিতীয় শর্তঃ আপনি নিজ ইচ্ছায় কুকুরকে অথবা বাজকে শিকারের পেছনে প্রেরণ করবেন। কুকুর অথবা বাজ যেন স্বেচ্ছায় শিকারের পেছনে দৌড়ে শিকার না করে। আলোচ্য আয়াতে এ শর্তটি (مكلبين) শব্দে বর্ণিত হয়েছে। এটি (تكليب) ধাতু থেকে উদ্ভুত। এর আসল অর্থ কুকুরকে শিক্ষা দেয়া। এরপর সাধারণ শিকার জন্তুকে শিক্ষা দেয়ার পর শিকারের দিকে প্রেরণ করা বা (ارسال) এর অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সুতরাং এর অর্থ শিকারের দিকে প্রেরণ করা। তৃতীয় শর্তঃ শিকার জন্তু নিজে শিকারকে খাবে না; বরং আপনার কাছে নিয়ে আসবে। এ শর্তটি (مِمَّا اَمْسَكْنَ عَلَيْكُمْ) বাক্যাংশে বর্ণিত হয়েছে। চতুর্থ শর্তঃ শিকারী কুকুর অথবা বাজকে শিকারের দিকে প্রেরণ করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে। উপরে বর্ণিত চারটি শর্ত পূর্ণ হলে শিকার আপনার হাতে পৌঁছার পূর্বেই যদি মরে যায়, তবুও তা হালাল হবে; যবেহ্ করার প্রয়োজন হবে না। আর যদি জীবিত অবস্থায় হাতে আসে, তবে যবেহ্ ব্যতীত হালাল হবে না। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, শিকার হিসেবে ঐসব বন্য জন্তুর ক্ষেত্রেই এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে, যে গুলো কারও করতলগত নয়। পক্ষান্তরে কোন বন্য জন্তু কারও করতলগত হয়ে গেলে, তা নিয়মিত যবেহ করা ব্যতীত হালাল হবে না। [ইবন কাসীর ও কুরতুবী থেকে সংক্ষেপিত]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবী আদী ইবন হাতিমকে বললেন, যখন তুমি শিকারের উদ্দেশ্যে তোমার কুকুরকে পাঠাবে এবং পাঠানোর সময় আল্লাহর নাম নিবে, তারপর যদি সে কুকুর কোন শিকার পাকড়াও করে, তবে তা থেকে খাও, যদিও সে শিকারটিকে হত্যা করে ফেলে থাকে। তবে যদি কুকুর সেটা থেকে নিজে খেয়ে নেয় সেটা ভিন্ন। সেটা খেয়ো না। কারণ, সেটা সে নিজের জন্য শিকার করেছে এমন আশঙ্কা রয়েছে। অনুরূপভাবে অন্য কুকুর এর সাথে মিশে শিকার করলেও সেটা খেয়ো না। [বুখারী ৫৪৭৫; মুসলিম: ১৯২৯]

: ৯৪
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَيَبْلُوَنَّكُمُ اللَّهُ بِشَيْءٍ مِنَ الصَّيْدِ تَنَالُهُ أَيْدِيكُمْ وَرِمَاحُكُمْ لِيَعْلَمَ اللَّهُ مَنْ يَخَافُهُ بِالْغَيْبِ ۚ فَمَنِ اعْتَدَىٰ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন শিকারের এমন বস্তু দ্বারা যা তোমাদের হাত [১] ও বর্শা [২] নাগাল পায়, যাতে আল্লাহ প্রকাশ করে দেন, কে তাঁকে গায়েবের সাথে ভয় করে [৩]। কাজেই এরপর কেউ সীমালংঘন করলে তার জন্য কষ্টদায়ক শাস্তি রয়েছে।

ফুটনোট

তেরতম রুকূ‘

[১] অর্থাৎ সহজলভ্য শিকার। কারণ, এগুলো মুহরিম ব্যক্তির আশেপাশেই থাকে। এর মাধ্যমে মুহরিম ব্যক্তির পরীক্ষা করা হয়। মুজাহিদ বলেন, এখানে ছোট ও বাচ্চা শিকারকে বোঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর]

[২] এর অর্থ বড় শিকার। [ইবন কাসীর] কারণ, বড় শিকার করতেই সাধারণতঃ বর্শা ব্যবহার করতে হয়।

[৩] মুকাতিল বলেন, মুসলিমরা যখন উমরা পালনের উদ্দেশ্যে হুদায়বিয়ায় অবস্থান করছিলেন, তখন এ আয়াত নাযিল হয়। সেখানে বন্য চতুষ্পদ জন্তু, পাখী এবং অন্যান্য শিকার তাদের অবস্থানস্থলে জমা হয়েছিল। এরূপ দৃশ্য তারা ইতোপূর্বে দেখেনি। সুতরাং ইহরামের অবস্থায় তাদেরকে শিকার করতে নিষেধ করা হয়, যাতে আল্লাহ্ তা’আলা স্পষ্ট করে দেন যে, কে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করছে, আর কে করছে না। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আপনি শুধু তাকেই সতর্ক করতে পারেন যে ‘যিকর’ এর অনুসরণ করে এবং গায়েবের সাথে রহমানকে ভয় করে। অতএব তাকে আপনি ক্ষমা ও সম্মানজনক পুরস্কারের সুসংবাদ দিন।’ [সূরা ইয়াসীন ১১] [ইবন কাসীর]

: ৯৫
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْتُلُوا الصَّيْدَ وَأَنْتُمْ حُرُمٌ ۚ وَمَنْ قَتَلَهُ مِنْكُمْ مُتَعَمِّدًا فَجَزَاءٌ مِثْلُ مَا قَتَلَ مِنَ النَّعَمِ يَحْكُمُ بِهِ ذَوَا عَدْلٍ مِنْكُمْ هَدْيًا بَالِغَ الْكَعْبَةِ أَوْ كَفَّارَةٌ طَعَامُ مَسَاكِينَ أَوْ عَدْلُ ذَٰلِكَ صِيَامًا لِيَذُوقَ وَبَالَ أَمْرِهِ ۗ عَفَا اللَّهُ عَمَّا سَلَفَ ۚ وَمَنْ عَادَ فَيَنْتَقِمُ اللَّهُ مِنْهُ ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ ذُو انْتِقَامٍ

হে ঈমানদারগণ! ইহরামে থাকাকালে তোমরা শিকার-জন্তু হত্যা করো না [১]; তোমাদের মধ্যে কেউ ইচ্ছে করে সেটাকে হত্যা করলে যা সে হত্যা করল তার বিনিময় হচ্ছে অনুরূপ গৃহপালিত জন্তু, যার ফয়সালা করবে তোমাদের মধ্যে দু’জন ন্যায়বান লোক –কা’বাতে পাঠানো হাদঈরূপে [২]। বা সেটার কাফ্‌ফারা হবে দরিদ্রকে খাদ্য দান করা কিংবা সমান সংখ্যক সিয়াম পালন করা, যাতে সে আপন কৃতকর্মের ফল ভোগ করে। যা গত হয়েছে আল্লাহ্‌ তা ক্ষমা করেছেন। কেউ তা আবারো করলে আল্লাহ্‌ তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।

ফুটনোট

[১] এ নিষেধাজ্ঞা অর্থের দিক দিয়ে ধরা হলে হালাল জন্তু, ওর বাচ্চা এবং হারাম প্রাণীগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। আর এটাই অধিকাংশ আলেমের মত। কারণ, যে প্রাণীগুলোকে সর্বাবস্থায় হত্যা করা বৈধ সেগুলোর বর্ণনা এক হাদীসে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে। তাই অপরাপর প্রাণীগুলো উক্ত নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। [ইবন কাসীর] যে প্রাণীগুলো ইহরাম ও সাধারণ সর্বাবস্থায় বধ করার কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা হচ্ছে, পাঁচটি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘পাঁচ প্রকার প্রাণী আছে যা ইহরাম অবস্থায় হত্যা করলে কোন পাপ হয় না। কাক, চিল, বিচ্ছু, ইঁদুর এবং হিংস্র কুকুর। [বুখারীঃ ১৮২৯, মুসলিমঃ ১১৯৯]

[২] অর্থাৎ এ হাদঈ বা জন্তু কা'বা পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। সেখানেই তা জবাই করতে হবে এবং হারাম শরীফের মিসকীনদের মধ্যে ওর গোশত বন্টন করতে হবে। এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই। [ইবন কাসীর] হজ্জের গুরুত্বপূর্ণ কর্ম হিসেবে হারাম এলাকায় যে পশু যবেহ করা হয় তাকে হাদঈ বলা হয়।

: ৯৭
جَعَلَ اللَّهُ الْكَعْبَةَ الْبَيْتَ الْحَرَامَ قِيَامًا لِلنَّاسِ وَالشَّهْرَ الْحَرَامَ وَالْهَدْيَ وَالْقَلَائِدَ ۚ ذَٰلِكَ لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

পবিত্র কা’বা ঘর, পবিত্র মাস, হাদঈ ও গলায় মালা পরানো পশুকে [১] আল্লাহ মানুষের কল্যাণের [২] জন্য নির্ধারিত করেছেন। এটা এ জন্য যে, তোমরা যেন জানতে পার, নিশ্চয় যা কিছু আসমানসমূহে ও যমীনে আছে আল্লাহ তা জানেন এবং নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা চারটি বস্তুকে মানুষের প্রতিষ্ঠা, স্থায়িত্ব ও শান্তির কারণ বলে উল্লেখ করছেন। প্রথমতঃ কা’বা। আরবী ভাষায় কাবা চতুষ্কোণবিশিষ্ট গৃহকে বলা হয়। জাহেলিয়াত যুগেও আল্লাহ তা’আলা আরবদের মনে হারাম শরীফের সম্মান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ফলে শান্তি ও নিরাপত্তা অব্যাহত ছিল। দ্বিতীয় বস্তুটি হচ্ছে, সম্মানিত মাস। সম্মানিত মাস বলে এখানে কারও কারও মতে, জিলহজ্জ মাস বোঝানো হয়েছে। অপর কারও কারও মতে, এর দ্বারা হারাম মাসসমূহ বোঝানো হয়েছে। আর তা হচ্ছে, রজব, জিলকদ ও জিলহজ ও মুহাররাম। তৃতীয় বস্তু হচ্ছে, ‘হাদঈ’। হারাম শরীফে যে জন্তুকে তামাত্তু ও কেরান হজের কারণে যবাই করতে হয়, তাকে হাদঈ বলা হয়। যে ব্যক্তির সাথে এরূপ জন্তু থাকত, সে নির্বিবাদে পথ চলতে পারত; তাকে কেউ কিছু বলত না। এভাবে কুরবানীর জন্তুও ছিল শান্তি ও নিরাপত্তার অন্যতম উপায়। চতুর্থ বস্তুটি হচ্ছে, (قلائد) এ শব্দটি (قلادة) শব্দের বহুবচন। এর অর্থ, গলার হার। আরবে প্রথা প্রচলিত ছিল যে, কেউ হজের উদ্দেশ্যে বের হলে চিহ্নস্বরূপ তার হাদঈর গলায় একটি হার পরিয়ে দিত। ফলে কেউ তাকে কোন কষ্ট দিত না। এ কারণে (قلادة) শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায় হয়ে যায়। [ফাতহুল কাদীর]

[২] (قيام) ও (قوام) এর অর্থ ঐসব বস্তু, যার উপর কোন বস্তুর স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। তাই (قِــيٰمًا لِّلنَّاسِ) এর অর্থ হবে এই যে, কাবা ও তৎসম্পর্কিত বস্তুসমূহ মানুষের প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্বের কারণ এবং উপায়। এর উপরই তাদের জীবিকা ও দ্বীন নির্ভরশীল। এর মাধ্যমেই তাদের দ্বীন ও দুনিয়ার কর্মকাণ্ড সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের মধ্যে যারা ভীত তারা সেখানে নিরাপত্তা পায়। যারা ব্যবসায়ী তারা ব্যবসায় লাভবান হয়। যারা ইবাদাত করতে চায়, তারা নির্বিয় ইবাদাত করতে পারে। [ফাততহুল কাদীর]

: ১৩৮
وَقَالُوا هَٰذِهِ أَنْعَامٌ وَحَرْثٌ حِجْرٌ لَا يَطْعَمُهَا إِلَّا مَنْ نَشَاءُ بِزَعْمِهِمْ وَأَنْعَامٌ حُرِّمَتْ ظُهُورُهَا وَأَنْعَامٌ لَا يَذْكُرُونَ اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا افْتِرَاءً عَلَيْهِ ۚ سَيَجْزِيهِمْ بِمَا كَانُوا يَفْتَرُونَ

আর তারা তাদের ধারণা অনুযায়ী বলে, ‘এসব গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত্র নিষিদ্ধ; আমরা যাকে ইচ্ছে করি সে ছাড়া কেউ এসব খেতে পারবে না,’ এবং কিছু সংখ্যক গবাদি পশুর পিঠে আরোহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং কিছু সংখ্যক পশু যবেহ করার সময় তারা আল্লাহর নাম নেয় না। এ সবকিছুই তারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রটনার উদ্দেশ্যে বলে; তাদের এ মিথ্যা রটনার প্রতিফল তিনি অচিরেই তাদেরকে দেবেন।
ফুটনোট

: ১৩৯
وَقَالُوا مَا فِي بُطُونِ هَٰذِهِ الْأَنْعَامِ خَالِصَةٌ لِذُكُورِنَا وَمُحَرَّمٌ عَلَىٰ أَزْوَاجِنَا ۖ وَإِنْ يَكُنْ مَيْتَةً فَهُمْ فِيهِ شُرَكَاءُ ۚ سَيَجْزِيهِمْ وَصْفَهُمْ ۚ إِنَّهُ حَكِيمٌ عَلِيمٌ

তারা আরো বলে, ‘এসব গবাদি পশুর পেটে যা আছে তা আমাদের পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট এবং এটা আমাদের স্ত্রীদের জন্য অবৈধ, আর সেটা যদি মৃত হয় তবে সবাই এতে অংশীদার।’ ‘তিনি তাদের এরূপ বলার প্রতিফল অচিরেই তাদেরকে দেবেন; নিশ্চয় তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ [১]।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতসমূহে অব্যাহতভাবে এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে যে, গাফেল ও মূৰ্খ মানুষ ভূ-মণ্ডল ও নভোমণ্ডলের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্-প্রেরিত আইন পরিত্যাগ করে পৈতৃক ও মনগড়া কুপ্রথাকে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করেছে। আল্লাহ তা'আলা যেসব বস্তু অবৈধ করেছিলেন, সেগুলোকে তারা বৈধ মনে করে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। পক্ষান্তরে আল্লাহ কর্তৃক হালালকৃত অনেক বস্তুকে তারা নিজেদের জন্য হারাম করে নিয়েছে এবং কোন কোন বস্তুকে শুধু পুরুষদের জন্য হালাল, স্ত্রীলোকদের জন্য হারাম করেছে। আবার কোন কোন বস্তু স্ত্রীলোকদের জন্য হালাল, পুরুষদের জন্য হারাম করেছে।

: ১৪২
وَمِنَ الْأَنْعَامِ حَمُولَةً وَفَرْشًا ۚ كُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ

আর গবাদি পশুর মধ্যে কিছু সংখ্যক ভারবাহী ও কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্রাকার পশু সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ যা রিযিকরূপে তোমাদেরকে দিয়েছেন তা থেকে খাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না; সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শক্র;
ফুটনোট

: ১৪৬
وَعَلَى الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا كُلَّ ذِي ظُفُرٍ ۖ وَمِنَ الْبَقَرِ وَالْغَنَمِ حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ شُحُومَهُمَا إِلَّا مَا حَمَلَتْ ظُهُورُهُمَا أَوِ الْحَوَايَا أَوْ مَا اخْتَلَطَ بِعَظْمٍ ۚ ذَٰلِكَ جَزَيْنَاهُمْ بِبَغْيِهِمْ ۖ وَإِنَّا لَصَادِقُونَ

আর আমরা ইয়াহূদীদের জন্য নখরযুক্ত সমস্ত পশু হারাম করেছিলাম এবং গরু ও ছাগলের চর্বিও তাদের জন্য হারাম করেছিলাম, তবে এগুলোর পিঠের অথবা অস্ত্রের কিংবা অস্থিসংলগ্ন চর্বি ছাড়া, তাদের অবাধ্যতার জন্য তাদেরকে এ প্রতিফল দিয়েছিলাম। আর নিশ্চয় আমরা সত্যবাদী।
ফুটনোট

: ৫৫
إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللَّهِ الَّذِينَ كَفَرُوا فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ

বিচরণকারী প্রাণীদের মধ্যে তারাই তো আল্লাহ্‌র কাছে নিকৃষ্ট, যারা কুফরী করেছে। সুতরাং তারা ঈমান আনবে না।
ফুটনোট

১০ : ২৪
إِنَّمَا مَثَلُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ وَالْأَنْعَامُ حَتَّىٰ إِذَا أَخَذَتِ الْأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيْهَا أَتَاهَا أَمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأَنْ لَمْ تَغْنَ بِالْأَمْسِ ۚ كَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

দুনিয়ার জীবনের দৃষ্টান্ত তো এরূপঃ যেমন আমরা আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি যা দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদ্গত হয়, যা থেকে মানুষ ও জীব-জন্তু খেয়ে থাকে। তারপর যখন ভূমি তার শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয় এবং তার অধিকারিগণ মনে করে সেটা তাদের আয়ত্তাধীন, তখন দিনে বা রাতে আমাদের নির্দেশ এসে পড়ে তারপর আমরা তা এমনভাবে নির্মূল করে দেই, যেন গতকালঅ সেটার অস্তিত্ব ছিল না [১]। এভাবে আমরা আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করি এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে [২]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ দুনিয়ার যাবতীয় বস্তু এতই ক্ষনস্থায়ী যে, সেটা হস্তচু্যত হয়ে গেলে এমন মনে হয় যেন তা কোনদিনই তার ছিল না। পক্ষান্তরে আখেরাতের নেয়ামত এমন হবে যে, তার তুলনায় দুনিয়ার সব দুঃখ কষ্ট মানুষ বেমালুম ভুলে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে বলেনঃ “দুনিয়ার সবচেয়ে বেশী নেয়ামতের অধিকারীকে কিয়ামতের দিন নিয়ে আসা হবে তারপর তাকে জাহান্নামের আগুনে একবার ঢুকিয়ে আনার পর জিজ্ঞাসা করা হবে তুমি কি তোমার দুনিয়ার জীবনে কোন ভাল বা কল্যাণ কিছু পেয়েছিলে? তুমি কি কোন নেয়ামত পেয়েছিলে? সে বলবেঃ না। অপরপক্ষে, দুনিয়াতে সবচেয়ে কঠিন কষ্টের মধ্যে ছিল এমন লোককে নিয়ে আসা হবে তারপর তাকে জান্নাতে ঢুকিয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি কি কখনো দুঃখ কষ্ট দেখেছিলে? সে বলবেঃ না " [মুসলিমঃ ২৮০৭]

[২] কারণ চিন্তাশীল মাত্রই বুঝতে পারে যে, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। শুধু তাই নয় ধোঁকাবাজও। দুনিয়ার চরিত্রই হলো এমন যে, যারা এর পিছনে ছুটে সে তাদের থেকে দূরে ছুটে যায় আর যারা তার থেকে দূরে থাকতে চায় সে তাদের পিছু নেয়। দুনিয়ার উদাহরণ হিসেবে আল্লাহ্ তা'আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে যমীনের মধ্যে উৎপন্ন উদ্ভিদ বলে উল্লেখ করেছেন [ইবন কাসীরা] যেমন, “তাদের কাছে পেশ কর উপমা দুনিয়ার জীবনের: এটা পানির ন্যায় যা আমরা বর্ষণ করি আকাশ থেকে, যা দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদগত হয়, তারপর তা বিশুষ্ক হয়ে এমন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় যে, বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ্ সব কিছুর উপর শক্তিমান” [সূরা আল-কাহফ: ৪৫] অনুরূপ আয়াত আরও এসেছে সূরা আয-যুমার ও সূরা আল-হাদীদে। [ইবন কাসীর]

১৬ : ১০
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً ۖ لَكُمْ مِنْهُ شَرَابٌ وَمِنْهُ شَجَرٌ فِيهِ تُسِيمُونَ

তিনিই আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন। তাতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা থেকে জন্মায় উদ্ভিদ যাতে তোমরা পশু চারণ করে থাক [১]।

ফুটনোট

[১] পূর্বের আয়াতসমূহে আল্লাহ্‌ রাববুল আলামীন যমীনে যে সমস্ত প্রাণী চলাফেরা করে তাদেরকে মানুষের উপকারের জন্য সৃষ্টি করেছেন সে ঘোষণা দিয়েছেন। এখানে আকাশ থেকে বৃষ্টি নাযিল করার মাধ্যমে মানুষের কি উপকার সাধিত হয় সেটা বর্ণনা করছেন। [ইবন কাসীর] এর মধ্যে প্রথমেই হচ্ছে পানি। তিনি আকাশ থেকে যে পানি নাযিল করেন সেগুলোকে তিনি সুমিষ্ট করেছেন, লবনাক্ত করেন নি। [ইবন কাসীর] অনুরূপভাবে মানুষের জন্য বৃক্ষের ব্যবস্থা করেছেন। (شجر) শব্দটি প্রায়ই বৃক্ষ অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা কাণ্ডের উপর দণ্ডায়মান থাকে। কোন কোন সময় এমন প্রত্যেক বস্তুকেও (شجر) বলা হয় যা ভূ-পৃষ্ঠে উৎপন্ন হয়। ঘাস, লতা-পাতা ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত থাকে। আলোচ্য আয়াতে এ অর্থই বোঝানো হয়েছে। [কুরতুবী]

কেননা, এর পরেই জন্তুদের চলার কথা বলা হয়েছে। ঘাসের সাথেই এর বেশীর ভাগ সম্পর্ক। (تُسِيْمُوْنَ) শব্দটির অর্থ জন্তুকে চারণক্ষেত্রে চরার জন্য ছেড়ে দেয়া। [কুরতুবী; ইবন কাসীর] অর্থাৎ তোমাদের জন্য এমন গাছের ব্যবস্থা করেছেন যাতে তোমাদের জীব-জন্তু চরে বেড়াতে পারে। [ইবন কাসীর]

২২ : ২৭
وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَىٰ كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ

আর মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দিন [১], তারা আপনার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সব ধরনের কৃশকায় উটের পিঠে করে, তারা আসবে দুর-দুরান্তের পথ অতিক্রম করে [২]

ফুটনোট

[১] ইবরাহীম 'আলাইহিস সালাম-এর প্রতি তৃতীয় আদেশ এই যে, মানুষের মধ্যে ঘোষণা করে দিন যে, বায়তুল্লাহর হজ্জ তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে। ইবনে আবী হাতেমা ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন যে, যখন ইবরাহীম 'আলাইহিস সালাম-কে হজ্জ ফরয হওয়ার কথা ঘোষণা করার আদেশ দেয়া হয়, তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরয করলেনঃ এখানে তো জনমানবহীন প্রান্তর। ঘোষণা শোনার মত কেউ নেই; যেখানে জনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কিভাবে পৌঁছবে? জবাবে আল্লাহ তা'আলা বললেনঃ আপনার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা করা। বিশ্বে পৌছানোর দায়িত্ব আমার। ইবরাহীম 'আলাইহিস সালাম মাকামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলে আল্লাহ তা'আলা তা উচ্চ করে দেন। কোন কোন বর্ণনায় আছে, তিনি আবু কুবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে আঙ্গুলি রেখে ডানে-বামে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ করে বললেনঃ “লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তা গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের উপর এই গৃহের হজ ফরয করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন কর।” এই বর্ণনায় আরো বলা হয়েছে যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর এই আওয়াজ আল্লাহ তা'আলা বিশ্বের কোণে কোণে পৌঁছে দেন এবং শুধু তখনকার জীবিত মানুষ পর্যন্তই নয়; বরং ভবিষ্যতে কেয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আগমনকারী ছিল, তাদের প্রত্যেকের কান পর্যন্ত এ আওয়াজ পৌছে দেয়া হয়। যার যার ভাগ্যে আল্লাহ্ তা'আলা হজ লিখে দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই এই আওয়াজের জবাবে

لَبَّيْكَ اللّٰهُمَّ لَبَّيْكَ

বলেছে। অর্থাৎ হাজির হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ ইবরাহিমী আওয়াজের জবাবই হচ্ছে হজ্জে ‘লাব্বাইকা' বলার আসল ভিত্তি। [দেখুন- তাবারীঃ ১৪/১৪৪, হাকীম মুস্তাদরাকঃ ২/৩৮৮]

[২] এ আয়াতে সেই প্রতিক্রিয়া বৰ্ণনা করা হয়েছে, যা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর ঘোষণাকে সব মানবমণ্ডলী পর্যন্ত পৌঁছানোর কারণে কেয়ামত পর্যন্তের জন্য কায়েম হয়ে গেছে। তা এই যে, বিশ্বের প্রতিটি প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও মানুষ বায়তুল্লাহর দিকে চলে আসবে; কেউ পদব্রজে, কেউ সওয়ার হয়ে। যারা সওয়ার হয়ে আসবে, তারাও দূর-দূরান্ত দেশ থেকে আগমন করবে। ফলে তাদের সওয়ারীর জন্তুগুলো কৃশকায় হয়ে যাবে। পরবর্তী নবীগণ এবং তাদের উম্মতগণও এই আদেশের অনুসারী ছিলেন। ঈসা 'আলাইহিস সালাম-এর পর যে সুদীর্ঘ জাহেলিয়াতের যুগ অতিবাহিত হয়েছে, তাতেও আরবের বাসিন্দারা মূর্তিপূজায় লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও হজ্জের বিধান তেমনিভাবে পালন করেছে, যেমন ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম থেকে বর্ণিত ছিল। যদিও পরবর্তীতে আরবরা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থায় হজ্জের সঠিক পদ্ধতি পরিবর্তন করে নিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সে সমস্ত ভুলের সংশোধন করে দিয়েছিলেন।

২২ : ৩৩
لَكُمْ فِيهَا مَنَافِعُ إِلَىٰ أَجَلٍ مُسَمًّى ثُمَّ مَحِلُّهَا إِلَى الْبَيْتِ الْعَتِيقِ

এ সব চতুষ্পদ জন্তুগুলোতে তোমাদের জন্য নানাবিধ উপকার রয়েছে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত [১]; তারপর তাদের যবাইয়ের স্থান হচ্ছে প্রাচীন ঘরটির কাছে [২]।

ফুটনোট

[১] পূর্বের আয়াতে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাকে মনের তাকওয়ার আলামত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর যেহেতু হাদঈ তথা হজ্জ অথবা ওমরাহকারী ব্যক্তি যবেহ করার জন্য যে জন্তু সাথে নিয়ে যায়, তাও হজ্জের একটি নিদর্শন। যেমন কুরআন নিজেই পরবর্তী পর্যায়ে বলছেঃ “এবং এ সমস্ত হাদঈর উটকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত করেছি।" [৩৬] অর্থাৎ হাজীদের সাথে আনা হাদঈর পশুও আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তাই বলে কি এ সমস্ত চতুষ্পদ জন্তু থেকে দুধ, সওয়ারী, মাল পরিবহণ ইত্যাদি সর্বপ্রকার উপকার লাভ করা কি হালাল নয়? আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান দেখানোর যে হুকুম ওপরে দেয়া হয়েছে তার দাবী কি এই যে, কুরবানীর পশুগুলোকে যখন আল্লাহর ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাদেরকে কোন ভাবে ব্যবহার করা যাবে না? তাদের পিঠে চড়া অথবা পিঠে জিনিসপত্র চাপিয়ে দেয়া কিংবা তাদের দুধ পান করা কি আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান দেখাবার বিরোধী? আরবের লোকেরা একথাই মনে করতো। তারা এ পশুগুলোকে একেবারেই আরোহীশূন্য অবস্থায় সুসজ্জিত করে নিয়ে যেতো। পথে তাদের থেকে কোন প্রকার লাভবান হওয়া তাদের দৃষ্টিতে ছিল পাপ। এ ভুল ধারণা দূর করার জন্য এখানে বলা হচ্ছে, জবাই করার জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তোমরা এ পশুদের থেকে লাভবান হতে বা উপকার অর্জন করতে পারো। এটা আল্লাহর নিদর্শনালীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিরোধী নয়। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীস রয়েছে। [দেখুন- বুখারীঃ ১৬৯০, মুসলিমঃ ২৩:২৩, ১৩২৪]

[২] এখানে الْبَيْتِ الْعَتِيْقِ (প্রাচীন গৃহ) বলতে কা'বা বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এর দ্বারা কি শুধু কা'বা উদ্দেশ্য না কি পূর্ণ হারাম উদ্দেশ্য ?

যদি শুধু কা'বা উদ্দেশ্য নেয়া হয় তখন এর অর্থ হবে, হজের কর্মকাণ্ড, আরাফায় অবস্থান, পাথর নিক্ষেপ, সায়ী ইত্যাদি সবই বাইতুল্লাহর তাওয়াফে ইফাদার মাধ্যমে শেষ হবে। আর তখন محل শব্দের অর্থ হবে, মুহরিমের জন্য ইহরাম থেকে হালাল হওয়ার স্থান। [কুরতুবী] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে এ তাফসীরটি বর্ণিত আছে। তিনি বলেছেন, কেউ বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করার সাথে সাথে হালাল হয়ে যাবে। তারপর তিনি এ আয়াতাংশ তেলাওয়াত করলেন। [ইবন কাসীর] ইবনুল আরাবী এখানে এ অর্থকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ, আয়াতে স্পষ্টভাবে কা'বার কথা আছে। [আহকামুল কুরআন; কুরতুবী]

আর যদি 'প্রাচীন গৃহ' বলে পূর্ণ হারাম এলাকা বোঝানো হয়ে থাকে, তখন আয়াতের অর্থ হবে, হাদঈ কা'বার কাছে পৌছতে হবে। আর - অর্থ হাদঈর জন্তুর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার স্থান বা যবেহ করার স্থান বোঝানো হয়েছে। কারণ, হারাম বায়তুল্লাহরই বিশেষ আঙিনা। সে হিসেবে আয়াতের অর্থ এই যে, হাদঈর জন্তু যবেহ করার স্থান বায়তুল্লাহর সন্নিকট; অর্থাৎ সম্পূর্ণ হারাম এলাকা। এতে বোঝা গেল যে, হারাম এলাকার ভিতরে হাদঙ্গ যবোহ করা জরুরী, হারাম এলাকার বাইরে জায়েয নয়। হারাম এলাকার যে কোন স্থানে হাদঈর প্রাণী যবোহ করা যাবে। সে হিসেবে মক্কার হারাম এলাকা, মিনা, মুযদালফার যেখানেই হাদঈর প্রাণী যবোহ করা হোক, তা শুদ্ধ হবে। শুধু কা'বা ঘরের কাছে হতে হবে এমন কথা নেই। আয়াতের অর্থ এই নয় যে, কাবাঘরে বা মসজিদে হারামে হাদঈ জবাই করতে হবে বরং এর অর্থ হচ্ছে হারামের সীমানার মধ্যে হাদঈ জবাই করতে হবে।

২২ : ৩৬
وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ ۖ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ ۖ فَإِذَا وَجَبَتْ جُنُوبُهَا فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ ۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرْنَاهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

আর উট [১] কে আমরা আল্লাহ্‌র নিদর্শনগুলোর অন্যতম করেছি [২]; তোমাদের জন্য তাতে অনেক মঙ্গল রয়েছে [৩]। কাজেই এক পা বাঁধা ও বাকী তিনপায়ে দাঁড়ানো অবস্থায় তাদের উপর তোমরা আল্লাহ্‌র নাম উচ্চারণ কর [৪]। তারপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায় [৫] তখন তোমরা তা থেকে খাও এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্থকে ও সাহায্যপ্রার্থীদেরকে [৬]; এভাবে আমরা সেগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।

ফুটনোট

[১] মুলে البُدْن শব্দটি এসেছে। আরবী ভাষায় তা শুধুমাত্র উটের জন্য ব্যবহার করা হয়। [কুরতুবী] সাধারণতঃ ঐ উটকেই بدن বলা হয় যা কা‘বার জন্য ‘হাদঈ’ হিসেবে প্রেরণ করা হয়। আর ‘হাদঈ’ হচ্ছে, উট, গরু, ছাগল সবগুলোর জন্য ব্যবহৃত নাম। [কুরতুবী] তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানীর বিধানে গরুকেও উটের হুকুমের সাথে শামিল করেছেন। একটি উট কুরবানী করলে যেমন তা সাতজনের জন্য যথেষ্ট, ঠিক তেমনি সাত জন মিলে একটি গরু কুরবানী দিতে পারে। হাদীসে এসেছে, জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের হুকুম দিয়েছেন আমরা যেন কুরবানীতে উটের ক্ষেত্রে সাতজন এবং গরুর ক্ষেত্রে সাতজন শরীক হয়ে যাই।” [মুসলিমঃ ১২১৩] হজ্জের হাদঈতেও কুরবানীর মত একটি গরু, মহিষ ও উটে সাতজন শরীক হতে পারে। [কুরতুবী]

[২] পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, দ্বীন ইসলামের আলামতরূপে গণ্য হয়, এমন বিশেষ বিধি-বিধান ও ইবাদাতকে شعادٔر বলা হয়। হাদঈ যবেহ করা এমন বিধানাবলীর অন্যতম। কাজেই এ ধরণের বিধানসমূহ পালন করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

[৩] অর্থাৎ তোমরা তা থেকে ব্যাপকহারে কল্যাণ লাভ করে থাকো। দ্বীন ও দুনিয়ার সার্বিক উপকারিতা তাতে রয়েছে। এখানে কেন হাদঈ যবাই করতে হবে সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। মানুষ আল্লাহ্‌ প্রদত্ত যেসব জিনিস থেকে লাভবান হয় তার মধ্য থেকে প্রত্যেকটিই আল্লাহ্‌র নামে কুরবানী করা উচিত, শুধুমাত্র নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য নয় বরং আল্লাহ্‌র শ্রেষ্ঠত্ব ও মালিকানার স্বীকৃতি দেবার জন্যও, যাতে মানুষ মনে মনে ও কার্যত একথা স্বীকার করে যে, আল্লাহ্‌ আমাকে যা কিছু দিয়েছেন এ সবই তাঁর। তারপরও এর মাধ্যমে মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ করে থাকে। মুজাহিদ বলেন, এতে যেমন সওয়াব রয়েছে তেমনি রয়েছে উপকার। [ইবন কাসীর] দুনিয়ার উপকারিতা যেমন, খাওয়া, সদকা, ভোগ করা ইত্যাদি। [সা’দী] ইবরাহীম নাখা‘য়ী বলেন, যদি প্রয়োজন হয় তার উপর সওয়ার হতে পারবে এবং দুধ দুইয়ে খেতে পারবে। [ইবন কাসীর] আর আখেরাতের কল্যাণ তো আছেই।

[৪] صَوَافَّ শব্দের অর্থ তিন পায়ে ভর দিয়ে দণ্ডায়মান থাকবে এবং এক পা বাঁধা থাকবে। উটের জন্য এই নিয়ম। [কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] দণ্ডায়মান অবস্থায় উট কুরবানী করা সুন্নত ও উত্তম। অবশিষ্ট সব জন্তুকে শোয়া অবস্থায় যবেহ করা সুন্নত। [দেখুন, কুরতুবী] তাউস ও হাসান صَوَافَّ শব্দটির অর্থ করেছেন, খালেসভাবে। অর্থাৎ একান্তভাবে আল্লাহ্‌র জন্য। তাঁর নামের সাথে আর কারও নাম নিও না। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] এখানে “তাদের উপর আল্লাহ্‌র নাম নাও’’ বলে আল্লাহ্‌র নামে যবাই করার কথা বলা হয়েছে। ইসলামী শরী‘আতে আল্লাহ্‌র নাম না নিয়ে পশু যবেহ করার কোন অবকাশ নেই। তাছাড়া এখানে নাম নেয়ার অর্থ শুধু নাম উচ্চারণ নয় বরং মনে-প্ৰাণে আল্লাহ্‌র জন্য এবং তাঁরই নামে যবাই করা বুঝাবে। যদি কেউ আল্লাহ্‌র নাম উচ্চারণ করে এবং অন্য কোন ব্যক্তি যথা পীর, কবর, মাজার, জিন ইত্যাদির সন্তুষ্টি লাভের ইচ্ছা পোষণ করে তবে তা সম্পূর্ণভাবে হারাম ও শির্ক বলে বিবেচিত হবে।

[৫] এখানে وَجَبَتْ অর্থ سَقَطَتْ বা পড়ে যাওয়া করা হয়েছে। যেমন বাকপদ্ধতিতে বলা হয় الشَّمْسُ وَجَبَتْ অর্থাৎ সূর্য ঢলে পড়েছে। এখানে জন্তুর প্রাণ নিৰ্গত হওয়া বোঝানো হয়েছে। [কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] সুতরাং সম্পপূর্ণভাবে রূহ নিৰ্গত না হওয়া পর্যন্ত প্রাণী থেকে কিছু খাওয়া জায়েয নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ্‌ প্রতিটি বস্তুর উপর দয়া লিখে দিয়েছেন। সুতরাং যখন তোমরা হত্যা করবে, তখন সুন্দরভাবে তা কর। আর যখন যবাই করবে তখন সুন্দরভাবে তা কর। তোমাদের কেউ যেন তার ছুরিটি ধার দিয়ে নেয় এবং যবেহকৃত প্রাণীটিকে শান্তি দেয়।’’ [আবু দাউদঃ ২৮১৫]

[৬] যাদেরকে হাদঈ ও কুরবানীর গোশত দেয়া উচিত, পূর্ববতী আয়াতে তাদেরকে بادٔس বলা হয়েছে। এর অর্থ দুঃস্থ, অভাবগ্ৰস্ত। এই আয়াতে তদস্থলে مُعْتَرّ ও قَانِعٌ শব্দদ্বয়ের দ্বারা তার তাফসীর করা হয়েছে। قَانِعٌ ঐ অভাবগ্ৰস্ত ফকীরকে বলা হয়, যে কারো কাছে যাচঞা করে না, দারিদ্র্য সত্ত্বেও স্বস্থানে বসে থাকে এবং কেউ কিছু দিলে তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। পক্ষান্তরে مُعْتَرّ ঐ ফকীরকে বলা হয়, যে কিছু পাওয়ার আশায় অন্যত্র গমন করে-মুখে সওয়াল করুক বা না করুক। [দেখুন, ইবন কাসীর]

২৩ : ২৭
فَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِ أَنِ اصْنَعِ الْفُلْكَ بِأَعْيُنِنَا وَوَحْيِنَا فَإِذَا جَاءَ أَمْرُنَا وَفَارَ التَّنُّورُ ۙ فَاسْلُكْ فِيهَا مِنْ كُلٍّ زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ وَأَهْلَكَ إِلَّا مَنْ سَبَقَ عَلَيْهِ الْقَوْلُ مِنْهُمْ ۖ وَلَا تُخَاطِبْنِي فِي الَّذِينَ ظَلَمُوا ۖ إِنَّهُمْ مُغْرَقُونَ

তারপর আমরা তার কাছে ওহী পাঠালাম, ‘আপনি আমাদের চাক্ষুষ তত্ত্বাবধান ও আমাদের ওহী অনুযায়ী নৌযান নির্মাণ করুন, তারপর যখন আমাদের আদেশ আসবে এবং উনুন [১] উথলে উঠবে, তখন উঠিয়ে নেবেন প্রত্যেক জীবের এক এক জোড়া এবং আপনার পরিবার-পরিজনকে, তাদেরকে ছাড়া যাদের বিরুদ্ধে আগে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর তাদের সম্পর্কে আপনি আমাকে কিছু বলবেন না যারা যুলুম করেছে। তারা তো নিমজ্জিত হবে।

ফুটনোট

[১] تنور এ শব্দটির অর্থ উনুন বা চুল্লী। যা রুটি পাকানোর জন্য তৈরী করা হয়। এই অর্থই প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত। এর অপর অর্থ ভূপৃষ্ঠ। কেউ এর দ্বারা বিশেষ চুল্লীর অর্থ নিয়েছেন। কারও কারও মতে এটি কোন এক জায়গার নাম। তবে আল্লাহ্‌ তা‘আলাই ভাল জানেন তিনি এর দ্বারা কোন সুনির্দিষ্ট চুল্লি উদ্দেশ্য নিয়েছেন নাকি তখনকার যাবতীয় চুল্লিই উদ্দেশ্য নিয়েছেন। [এ ব্যাপারে সূরা হূদের ৪০ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা চলে গেছে]

২৪ : ৪৫
وَاللَّهُ خَلَقَ كُلَّ دَابَّةٍ مِنْ مَاءٍ ۖ فَمِنْهُمْ مَنْ يَمْشِي عَلَىٰ بَطْنِهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يَمْشِي عَلَىٰ رِجْلَيْنِ وَمِنْهُمْ مَنْ يَمْشِي عَلَىٰ أَرْبَعٍ ۚ يَخْلُقُ اللَّهُ مَا يَشَاءُ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

আর আল্লাহ্‌ সমস্ত জীব সৃষ্টি করেছেন পানি থেকে [১], অতঃপর তাদের কিছু সংখ্যক পেটে ভর দিয়ে চলে, কিছু সংখ্যক দু‘পায়ে চলে এবং কিছু সংখ্যক চলে চার পায়ে। আল্লাহ্‌ যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন, নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

ফুটনোট

[১] সুতরাং যেগুলো জন্তু সেগুলো বীর্য থেকে সৃষ্টি হয়। যা পুরুষ জন্তু মাদী জন্তুর উপর ফেলে। আর যেগুলো যমীনে তৈরী হয়, সেগুলোও আদ্র যমীন ছাড়া তৈরী হয় না। যেমন, কীট-পতঙ্গ। সুতরাং কোন কিছুই পানি ব্যতীত সৃষ্টি হয় না। [সা‘দী]

২৫ : ৪৮
وَهُوَ الَّذِي أَرْسَلَ الرِّيَاحَ بُشْرًا بَيْنَ يَدَيْ رَحْمَتِهِ ۚ وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً طَهُورًا

আর তিনিই তাঁর রহমতের বৃষ্টির আগে সুসংবাদবাহীরূপে বায়ু প্রেরণ করেন এবং আমরা আকাশ হতে পবিত্ৰ পানি বর্ষণ করি [১]-

ফুটনোট

[১] طهور শব্দটি আরবী ভাষায় অতিশয়ার্থে ব্যবহৃত হয়। কাজেই এমন জিনিসকে طهور বলা হয়, যা নিজেও পবিত্র এবং অপরকেও তদ্দারা পবিত্র করা যায়। [বাগভী]

২৫ : ৪৯
لِنُحْيِيَ بِهِ بَلْدَةً مَيْتًا وَنُسْقِيَهُ مِمَّا خَلَقْنَا أَنْعَامًا وَأَنَاسِيَّ كَثِيرًا

যাতে তা দ্বারা আমরা মৃত ভূ-খণ্ডকে সঞ্জীবিত করি এবং আমরা যা সৃষ্টি করেছি তার মধ্য হতে বহু জীবজন্তু ও মানুষকে তা পান করাই [১],

ফুটনোট

[১] আয়াতে বলা হয়েছে যে, আকাশ থেকে অবতীর্ণ পানি দ্বারা আল্লাহ্‌ তা‘আলা মাটিকে সিক্ত করেন এবং জীবজন্তু এবং অনেক মানুষেরও তৃষ্ণ নিবারণ করেন। [দেখুন-মুয়াসসার]

0:00
0:00