এতীম
এতীম
: ৮৩
وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ثُمَّ تَوَلَّيْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِنْكُمْ وَأَنْتُمْ مُعْرِضُونَ

আর স্মরণ কর, যখন আমরা ইসরাঈল-সন্তানদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কারো ‘ইবাদাত করবে না, মাতা-পিতা [১], আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও দরিদ্রের [২] সাথে সদয় ব্যবহার করবে এবং মানুষের সাথে সদালাপ করবে [৩]। আর সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দিবে, তারপর তোমাদের মধ্য হতে কিছুসংখ্যক লোক ছাড়া [৪] তোমরা সকলেই অবজ্ঞা করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে।

ফুটনোট

[১] আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহ্‌র রাসূল ! আল্লাহ্‌র কাছে কোন আমল সবচেয়ে উত্তম? তিনি বললেন, “সময়মত সালাত আদায় করা”। বললেন, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, “পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার" বললেন, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, “আল্লাহ্‌র পথে জিহাদ করা”। [বুখারী ৫২৭, মুসলিম: ৮৫]

[২] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মিসকীন সে নয়, যে এক খাবার বা দুই খাবারের জন্য ঘুরে বেড়ায় বরং মিসকীন হচ্ছে, যার সামর্থ নেই অথচ সে লজ্জায় কারও কাছে চায় না। অথবা মানুষকে আগলে ধরে কোন কিছু চায় না। ” [বুখারী: ১৪৭৬, মুসলিম: ১০৩৯]

[৩] আয়াতে এমন কথাকে বুঝানো হয়েছে, যা সৌন্দর্যমণ্ডিত। এর অর্থ এই যে, যখন মানুষের সাথে কথা বলবে, নম্রভাবে হাসিমুখে ও খোলামনে বলবে। তবে দ্বীনের ব্যাপারে শৈথিল্য অথবা কারো মনোরঞ্জনের জন্য সত্য গোপন করবে না। কারণ, আল্লাহ্ তা'আলা যখন মূসা ও হারূন ‘আলাইহিমাস সালাম-কে নবুয়ত দান করে ফি’রআউনের প্রতি পাঠিয়েছিলেন, তখন এ নির্দেশ দিয়েছিলেন, “ তোমরা উভয়েই ফির’আউনকে নরম কথা বলবে। " [সূরা ত্বা-হাঃ ৪৪]
আজ যারা অন্যের সাথে কথা বলে, তারা মূসা ‘আলাইহিস সালাম-এর চাইতে উত্তম নয় এবং যার সাথে কথা বলে, সেও ফিরআউন অপেক্ষা বেশী মন্দ বা পাপিষ্ঠ নয়। সুতরাং সবার সাথে সুন্দরভাবে কথা বলা উচিত। হাদীসে এসেছে, “তোমরা সৎকাজের সামান্যতম কিছুকে খাটো করে দেখ না। যদিও তা হয় তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাত করা। " [মুসলিম: ২৬২৬] তাছাড়া মানুষের সাথে সদালাপের অর্থ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে এক বর্ণনায় এসেছে যে, তা হচ্ছে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

[৪] ‘অল্প কয়েকজন’ অর্থ, তারাই যারা তাওরাতের পুরোপুরি অনুসরণ করত, তাওরাত রহিত হওয়ার পূর্বে তারা মূসা ‘আলাইহিস সালাম প্রবর্তিত শরীআতের অনুসারী ছিল এবং তাওরাত রহিত হওয়ার পর ইসলামী শরীআতের অনুসারী হয়ে যায়। আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, একত্ববাদে ঈমান, এবং পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজন, ইয়াতীম বালক-বালিকা ও দীন-দরিদ্রের সেবাযত্ন করা, মানুষের সাথে নম্রভাবে কথাবার্তা বলা, সালাত আদায় করা ও যাকাত দেয়া ইসলামী শরীআতসহ পূর্ববর্তী শরীআতসমূহেও ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মানুষ সেগুলো ত্যাগ করে।

: ১৭৭
لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا ۖ وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ ۗ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ

পূর্ব ও পশ্চিম দিকে [১] তোমাদের মুখ ফিরানোই সৎকর্ম নয়, কিন্তু সৎকর্ম হলো যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌, শেষ দিবস, ফেরেশ্‌তাগণ, কিতাবসমূহ ও নবীগণের প্রতি ঈমান [২] আনবে। আর সম্পদ দান করবে তার [৩] ভালবাসায় [৪] আত্মীয়-স্বজন [৫], ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী ও দাসমুক্তির জন্য এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত দিবে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করবে [৬], অর্থ-সংকটে, দুঃখ-কষ্টে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করবে [৭]। তারাই সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই মুত্তাকী।

ফুটনোট

[১] কাতাদাহ ও আবুল আলীয়াহ বলেন, ইয়াহুদীরা ইবাদাতের সময় পশ্চিম দিকে আর নাসারারা পূর্ব দিকে মুখ করে থাকে। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

আল্লাহ্ তাআলা তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় বলেন, সালাতে পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে কি পশ্চিমদিকে, এ বিষয় নির্ধারণকেই যেন তোমরা দ্বীনের একমাত্র লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছ এবং এ ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করেই তোমাদের যাবতীয় আলোচনা-সমালোচনা আবর্তিত হতে শুরু করেছে। মনে হয়, তোমাদের ধারণায় শরীআতের অন্য কোন হুকুম-আহকামই যেন আর নেই।

[২] অন্য অর্থে এ আয়াতের লক্ষ্য মুসলিম, ইয়াহুদী, নাসারা নির্বিশেষে সবাই হতে পারে। এমতাবস্থায় আয়াতের অর্থ দাঁড়াবে এই যে, প্রকৃত পুণ্য বা সওয়াব আল্লাহ্ তা'আলার আনুগত্যের ভেতরই নিহিত । যেদিকে মুখ করে তিনি সালাতে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন, সেটাই শুদ্ধ ও পুণ্যের কাজে পরিণত হয়ে যায়। অন্যথায়, দিক হিসাবে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণের কোনই বৈশিষ্ট্য নেই। দিকবিশেষের সাথে কোন পুণ্যও সংশ্লিষ্ট নয়। পুণ্য একান্তভাবে আল্লাহ্‌র প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের সাথেই সম্পৃক্ত। তাই আল্লাহ্‌ তা'আলা যতদিন বায়তুল-মুকাদ্দাসের প্রতি মুখ করে সালাত আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন, ততদিন সেদিকে মুখ করাই ছিল পুণ্য। আবার যখন মসজিদুল হারামের দিকে মুখ করে দাঁড়ানোর হুকুম হয়েছে, এখন এ হুকুমের আনুগত্য করাই পুণ্যে পরিণত হয়েছে। [মাআরিফুল কুরআন]

[৩] এখানে দুটি অর্থ হতে পারে, এক. আল্লাহ্‌র ভালবাসায় উপরোক্ত খাতে সম্পদ ব্যয় করা। দুই. সম্পদের প্রতি নিজের অতিশয় আসক্তি ও ভালাবাসা থাকা সত্বেও সে উপরোক্ত খাতসমূহে সম্পদ ব্যয় করা। উভয় অর্থই এখানে উদ্দেশ্য হতে পারে। তবে শেষোক্ত মতটিকেই অনেকে প্রাধান্য দিয়েছেন। [তাফসীরে বাগভী] এ মতের সপক্ষে বিভিন্ন হাদীসে সম্পদের আসক্তি সত্বেও তা ব্যয় করার ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। এক হাদীসে এসেছে, এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সব চেয়ে বেশী সওয়াবের সাদাকাহ কোনটি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি সুস্থ ও আসক্তিপূর্ণ অবস্থায়, দরিদ্র হয়ে যাওয়ার ভয়, ধনী হওয়ার আকাংখা থাকা সত্বেও সাদাকাহ করা”। [বুখারী: ১৪১৯, মুসলিম: ১০৩২]

[৪] এ আয়াতের বর্ণনাভঙ্গির দ্বারাই এ তথ্যও সাব্যস্ত হয়ে যায় যে, ধন-সম্পদের ফরয শুধুমাত্র যাকাত প্রদানের মাধ্যমেই পূর্ণ হয় না, যাকাত ছাড়া আরও বহু ক্ষেত্রে সম্পদ ব্যয় করা ফরয ও ওয়াজিব হয়ে থাকে। যেমন, রুযী-রোযগারে অক্ষম আত্মীয়-স্বজনের ব্যয়ভার বহন করা ওয়াজিব হয়ে যায়। কারো সামনে যদি কোন দরিদ্র ব্যক্তির জীবন বিপন্ন হয়, তবে যাকাত প্রদান করার পরেও সে দরিদ্রের জীবন রক্ষার্থে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা ফরয হয়ে পড়ে। অনুরূপ যেসব স্থানে প্রয়োজন রয়েছে, সেখানে মসজিদ তৈরী করা এবং দ্বানীশিক্ষার জন্য মক্তব-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করাও আর্থিক ফরযের অন্তর্গত। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, যাকাতের একটা বিশেষ বিধান রয়েছে, সে বিধান অনুযায়ী যে কোন অবস্থায় যাকাত প্রদান করতে হবে, কিন্তু অন্যান্য খরচের ফরয হওয়ার বেলায় প্রয়োজন দেখা দেয়া শর্ত। [মাআরিফুল কুরআন]

[৫] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সবচেয়ে উত্তম সদকাহ হচ্ছে সেটি যা এমন আত্মীয় স্বজনের জন্য করা হয় যারা তোমার থেকে বিমুখ হয়ে আছে”। [মুসনাদে আহমাদ:৩/৪০২, সহীহ ইবনে খুযাইমাহ: ৪/৭৮]

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মিসকীনের উপর সদকাহ করলে সেটি সদকাহ হিসেবে বিবেচিত হবে। পক্ষান্তরে যদি আত্মীয়-স্বজনের উপর সদকাহ করা হয় তবে তা হবে, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও সদকাহ। [মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৮]

[৬] অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তির মধ্যে ওয়াদা-অঙ্গীকার পূর্ণ করার অভ্যাস সব সময়ের জন্য থাকতে হবে, ঘটনাচক্রে কখনো কখনো অঙ্গীকার পূরণ করলে চলবে না। কেননা, এরূপ মাঝে-মধ্যে কাফের-গোনাহগাররাও ওয়াদা-অঙ্গীকার পূরণ করে থাকে। সুতরাং এটা ধর্তব্যের মধ্যে আসবে না। তেমনিভাবে মু’আমালাতের বর্ণনায় শুধুমাত্র অঙ্গীকার পূরণ করার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। একটু চিন্তা করলেই দেখা যায় যে, ক্রয়-বিক্রয়, অংশীদারিত্ব, ভাড়া-ইজারা প্রভৃতি বৈষয়িক দিকসমূহের সুষ্ঠতা ও পবিত্রতাই অঙ্গীকার পূরণের উপর নির্ভরশীল।

(৭) আখলাক বা মন-মানসিকতার সুস্থতা বিধান সম্পর্কিত বিধি-বিধানের আলোচনায় একমাত্র ‘সবর’-এর উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, ‘সবর’-এর অর্থ হচ্ছে মন-মানসিকতা তথা নফসকে বশীভূত করে অন্যায়-অনাচার থেকে সর্বোতভাবে সুরক্ষিত রাখা। একটু চিন্তা করলেই বুঝা যাবে যে, মানুষের হৃদয়বৃত্তিসহ আভ্যন্তরীণ যত আমল রয়েছে, সবরই সেসবের প্রাণস্বরূপ। এরই মাধ্যমে সর্বপ্রকার অন্যায় ও কদাচার থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হয়।

: ২১৫
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ ۖ قُلْ مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۗ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ

তারা কি ব্যয় করবে সে সম্পর্কে আপনাকে প্রশ্ন করে [১]। বলুন, ‘যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করবে তা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন এবং মুসাফিরদের জন্য। উত্তম কাজের যা কিছুই তোমরা কর আল্লাহ্‌ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ আমাদের সম্পদ হতে কি পরিমাণ ব্যয় করব এবং কোথায় ব্যয় করব? এ প্রশ্নে দু’টি অংশ রয়েছে। একটি হচ্ছে অর্থ-সম্পদের মধ্য থেকে কি বস্তু এবং কত পরিমাণ খরচ করা হবে? দ্বিতীয়টি হচ্ছে এই দানের পাত্র কারা? প্রথম অংশে অর্থাৎ কোথায় ব্যয় করবে সে সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছেঃ আল্লাহ্‌র রাস্তায় তোমরা যাই ব্যয় কর তার হকদার হচ্ছে, ‘তোমাদের পিতা-মাতা, নিকট আত্মীয় স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরগণ’। আর দ্বিতীয় অংশের জবাব অর্থাৎ কি ব্যয় করবে? এ প্রশ্নের উত্তর প্রাসঙ্গিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করে এরশাদ করা হয়েছে, ‘তোমরা যেসব কাজ করবে তা আল্লাহ্‌ তা'আলা জানেন’। বাক্যটিতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তোমাদের জন্যে কোন পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি যে, এতটুকু বাধ্যতামূলকভাবেই তোমাদেরকে ব্যয় করতে হবে এবং স্বীয় সামর্থ্যানুযায়ী যা কিছু তোমরা ব্যয় কর, আল্লাহ্‌র নিকট এর প্রতিদান পাবে।

: ২২০
فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۗ وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْيَتَامَىٰ ۖ قُلْ إِصْلَاحٌ لَهُمْ خَيْرٌ ۖ وَإِنْ تُخَالِطُوهُمْ فَإِخْوَانُكُمْ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ الْمُفْسِدَ مِنَ الْمُصْلِحِ ۚ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَأَعْنَتَكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

দুনিয়া ও আখেরাতের ব্যাপারে। আর লোকেরা আপনাকে ইয়াতীমদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে; বলুন, ‘তাদের জন্য সুব্যাবস্থা করা উত্তম’। তোমরা যদি তাদের সাথে একত্রে থাক তবে তারা তো তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ্‌ জানেন কে উপকারকারী এবং কে অনিষ্টকারী [১]। আর আল্লাহ্‌ ইচ্ছে করলে এ বিষয়ে তোমাদেরকে অবশ্যই কষ্টে ফেলতে পারতেন। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ প্রবল পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।

ফুটনোট

[১] ইবনে আব্বাস বলেন, যখন “তোমরা উত্তম পদ্ধতি ব্যতীত ইয়াতিমের সম্পদের কাছেও যেও না” [সূরা আল-আনআমঃ ১৫২, আল-ইসরা ৩৪]

নাযিল হল তখন অনেকেই ইয়াতিমদের থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখে। ফলে ইয়াতিমরা বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তখন এ আয়াত নাযিল করে আল্লাহ্‌ তা'আলা ইয়াতিমদের সাথে কিভাবে চলতে হবে তা জানিয়ে দেন। " [আবুদাউদ: ২৮৭১]

:
وَآتُوا الْيَتَامَىٰ أَمْوَالَهُمْ ۖ وَلَا تَتَبَدَّلُوا الْخَبِيثَ بِالطَّيِّبِ ۖ وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَهُمْ إِلَىٰ أَمْوَالِكُمْ ۚ إِنَّهُ كَانَ حُوبًا كَبِيرًا

আর ইয়াতীমদেরকে তোমরা তাদের ধন-সম্পদ সমর্পণ করো [১] এবং ভালোর সাথে মন্দ বদল করো না [২]। আর তোমাদের সম্পদের সাথে তাদের সম্পদ মিশিয়ে গ্রাস করো না; নিশ্চয় এটা মহাপাপ [৩]।

ফুটনোট

[১] আয়াতে বলা হয়েছে, ইয়াতীমের সম্পদ তাদেরকে যথার্থভাবে বুঝিয়ে দাও। আরবী ‘ইয়াতীম’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে- নিঃসঙ্গ। একটি ঝিনুকের মধ্যে যদি একটিমাত্র মুক্তা জন্ম নেয়, তখন একে ‘দুররাতুন-ইয়াতীমাতুন’ বা ‘নিঃসঙ্গ মুক্তা’ বলা হয়ে থাকে। ইসলামী পরিভাষায় যে শিশু-সন্তানের পিতা ইন্তেকাল করে, তাকে ইয়াতীম বলা হয়। ছেলে-মেয়ে বালেগ হয়ে গেলে তাদেরকে ইসলামী পরিভাষায় ইয়াতীম বলা হয় না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বালেগ হওয়ার পর আর কেউ ইয়াতীম থাকে না ।’ [আবু দাউদঃ ২৮৭৩]

ইয়াতীম যদি পারিতোষিক অথবা উপঢৌকন হিসেবে কিছু সম্পদপ্রাপ্ত হয়, তাহলে ইয়াতীমের অভিভাবকের দায়িত্ব হচ্ছে সেসব মালেরও হেফাজত করা। ইয়াতীমের মৃত পিতা অথবা দেশের সরকার যে-ই উক্ত অভিভাবককে মনোনীত করুক না কেন; তার উপরই ইয়াতীমের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বর্তায়। উক্ত অভিভাবকের উচিত, ইয়াতীমের যাবতীয় প্রয়োজন তার গচ্ছিত ধন-সম্পদ থেকে নির্বাহ করা। এ আয়াতে ইয়াতিমের সম্পদ তার হাতে বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোন শর্তারোপ করা হয়নি। পক্ষান্তরে পরবর্তী ৬ নং আয়াতে এ সম্পদ তাদের কাছে প্রত্যার্পণ করার জন্য দু’টি শর্ত দিয়েছে। এক, ইয়াতীম বালেগ হতে হবে, দুই, ভাল-মন্দ বিবেচনা করার ক্ষমতা থাকতে হবে। কারণ, বালেগ হওয়ার পূর্বে তার জ্ঞান ও বুদ্ধি-বিবেচনা সম্পত্তি সংরক্ষণের মত না হওয়াই স্বাভাবিক। দুটো বিষয় তাদের মধ্যে পাওয়া গেলে তাদের সম্পদ তাদের কাছে ফেরৎ দেয়া উচিত। [আদওয়াউল বায়ান]

[২] মুজাহিদ বলেন, এর অর্থ তোমরা হালালকে হারামের সাথে মিশিয়ে ফেলো না। [তাবারী]

[৩] এ আয়াতে ইয়াতিমের সম্পদ গ্রাস করাকে বড় গুনাহ্‌ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু গোনাহের পরিণাম সম্পর্কে এখানে কিছু বলা হয়নি। এ সূরারই ১০ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সেটা ঘোষণা করে বলেছেন, “যারা ইয়াতীমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে তারা তো তাদের পেটে আগুনই খাচ্ছে; তারা অচিরেই জ্বলন্ত আগুনে জুলবে”। [আদওয়াউল বায়ান]

:
وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا فِي الْيَتَامَىٰ فَانْكِحُوا مَا طَابَ لَكُمْ مِنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ ۖ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَلَّا تَعُولُوا

আর যদি তোমরা আশংকা কর যে, ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি [১] সুবিচার করতে পারবে না [২], তবে বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভাল লাগে, দুই, তিন বা চার [৩]; আর যদি আশংকা কর যে সুবিচার করতে পারবে না [৪] তবে একজনকেই বা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকেই গ্রহণ কর। এতে পক্ষপাতিত্ব [৫] না করার সম্ভাবনা বেশী।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে ইয়াতীম মেয়েদের বৈবাহিক জীবনের যাবতীয় অধিকার সংরক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সাধারণ আইন-কানুনের মত তা শুধু প্রশাসনের উপর ন্যস্ত করার পরিবর্তে জনসাধারণের মধ্যে আল্লাহ-ভীতির অনুভূতি জাগ্রত করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যদি ইনসাফ করতে পারবে না বলে মনে কর, তাহলে ইয়াতীম মেয়েদেরকে বিয়ে করবে না; বরং সে ক্ষেত্রে অন্য মেয়েদেরকেই বিয়ে করে নেবে। এ কথা বলার সাথে সাথে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। যাতে ইয়াতীম ছেলে-মেয়েদের কোন প্রকার অধিকার ক্ষুন্ন না হয় সে ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

[২] জাহেলিয়াত যুগে ইয়াতীম মেয়েদের অধিকার চরমভাবে ক্ষুন্ন করা হত। যদি কোন অভিভাবকের অধিনে কোন ইয়াতীম মেয়ে থাকত আর তারা যদি সুন্দরী হত এবং তাদের কিছু সম্পদ-সম্পত্তিও থাকত, তাহলে তাদের অভিভাবকরা নামমাত্র মাহ্‌র দিয়ে তাদেরকে বিয়ে করে নিত অথবা তাদের সন্তানদের সাথে বিয়ে দিয়ে সম্পত্তি আত্মসাৎ করার চক্রান্ত করত। এসব অসহায় মেয়েদের পূর্ণ অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থার কথা তারা চিন্তাও করত না। আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত আছে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ঠিক এ ধরণের একটি ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। ‘জনৈক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে একটি ইয়াতীম মেয়ে ছিল। সে ব্যক্তির একটি বাগান ছিল, যার মধ্যে উক্ত ইয়াতীম বালিকাটিরও অংশ ছিল। সে ব্যক্তি উক্ত মেয়েটিকে বিয়ে করে নিল এবং নিজের পক্ষ থেকে ‘দেন-মাহ্‌র’ আদায় তো করলই না, বরং বাগানে মেয়েটির যে অংশ ছিল তাও সে আত্মসাৎ করে নিল। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়’। [বুখারীঃ ৪৫৭৩]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, তখনকার দিনে কারও কাছে কোন ইয়াতীম থাকলে এবং তার সম্পদ ও সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করলে সে তাকে বিয়ে করতে চাইত। তবে তাকে অন্যদের সমান মাহ্‌র দিতে চাইত না। তাই তাদের মাহ্‌র পূর্ণ ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের না দিয়ে বিয়ে করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের ব্যাপারে কোন প্রকার ক্রটি করার ইচ্ছা থাকলে তাদের বাদ দিয়ে অন্যান্য মহিলাদের বিয়ে করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। [বুখারীঃ ৪৫৭৪] তবে এর অর্থ এই নয় যে, অন্যান্য নারীদের বেলায় ইনসাফ বিধান করা লাগবে না। বরং অন্যান্য নারীদের বেলায়ও তা করতে হবে। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

[৩] বহু-বিবাহ প্রথাটি ইসলামপূর্ব যুগেও দুনিয়ার প্রায় সকল ধর্মমতেই বৈধ বলে বিবেচিত হত। আরব, ভারতীয় উপমহাদেশ, ইরান, মিশর, ব্যাবিলন প্রভৃতি দেশেই এই প্রথার প্রচলন ছিল। বহু-বিবাহের প্রয়োজনীয়তার কথা বর্তমান যুগেও স্বীকৃত। বর্তমান যুগে ইউরোপের এক শ্রেণীর চিন্তাবিদ বহু-বিবাহ রহিত করার জন্য তাদের অনুসারীদেরকে উদ্ভুদ্ধ করে আসছেন বটে, কিন্তু তাতে কোন সুফল হয়নি। বরং তাতে সমস্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফল রক্ষিতার রূপে প্রকাশ পেয়েছে। অবশেষে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ব্যবস্থারই বিজয় হয়েছে। তাই আজকে ইউরোপের দূরদর্শী চিন্তাশীল ব্যাক্তিরা বহু-বিবাহ পুনঃপ্রচলন করার জন্য চিন্তা-ভাবনা করছেন। ইসলাম একই সময়ে চারের অধিক স্ত্রী রাখাকে হারাম ঘোষণা করেছে। ইসলাম এ ক্ষেত্রে ইনসাফ কায়েমের জন্য বিশেষ তাকিদ দিয়েছে এবং ইনসাফের পরিবর্তে যুলুম করা হলে তার জন্য শাস্তির কথা ঘোষণা করেছে। আলোচ্য আয়াতে একাধিক অর্থাৎ চারজন স্ত্রী গ্রহণ করার সুযোগ অবশ্য দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে এই চার পর্যন্ত কথাটি আরোপ করে তার উর্ধ্ব সংখ্যক কোন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবে না বরং তা হবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ -তাও ব্যক্ত করে দিয়েছে। ইসলাম পূর্ব যুগে কারও কারও দশটি পর্যন্ত স্ত্রী থাকত। ইসলাম এটাকে চারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। কায়েস ইবন হারেস বলেন, ‘আমি যখন ইসলাম গ্রহণ করি তখন আমার স্ত্রী সংখ্যা ছিল আট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে আসলে তিনি আমাকে বললেন, ‘এর মধ্য থেকে চারটি গ্রহণ করে নাও’। [ইবন মাজাহ: ১৯৫২, ১৯৫৩]

[৪] পবিত্র কুরআনে চারজন স্ত্রীর কথা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সাথে সাথে এও বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা তাদের মধ্যে সমতা বিধান তথা ন্যায় বিচার করতে না পার, তাহলে এক স্ত্রীর উপরই নির্ভর কর। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, একাধিক বিয়ে ঠিক তখনই বৈধ হতে পারে, যখন শরী’আত মোতাবেক সবার সাথে সমান আচরণ করা হবে; তাদের সবার অধিকার সমভাবে সংরক্ষণ করা হবে। এ ব্যাপারে অপারগ হলে এক স্ত্রীর উপরই নির্ভর করতে হবে এবং এটাই ইসলামের নির্দেশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক স্ত্রীর বেলায় সবার সাথে পরিপূর্ণ সমতার ব্যবহার করার ব্যাপারে বিশেষ তাকিদ দিয়েছেন এবং যারা এর খেলাফ করবে, তাদের জন্য কঠিন শাস্তির খবর দিয়েছেন। নিজের ব্যবহারিক জীবনেও তিনি এ ব্যাপারে সর্বোত্তম আদর্শ স্থাপন করে দেখিয়েছেন। এমনকি তিনি এমন বিষয়েও সমতাপূর্ণ আদর্শ স্থাপন করেছেন যে ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন ছিল না। এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ ‘যে ব্যক্তির দুই স্ত্রী রয়েছে, সে যদি এদের মধ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ করতে না পারে, তবে কিয়ামতের ময়দানে সে এমনভাবে উঠবে যে, তার শরীরের এক পার্শ্ব অবশ হয়ে থাকবে’। [আবু দাউদঃ ২১৩৩, তিরমিযীঃ ১১৪১, ইবন মাজাহঃ ১৯৬৯, আহমাদঃ ২/৪৭১]

এ সূরার ১২৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, কোন এক স্ত্রীর প্রতি যদি তোমার আন্তরিক আকর্ষণ বেশী হয়ে যায়, তবে সেটা তোমার সাধ্যায়ত্ব ব্যাপার নয় বটে, কিন্তু এ ক্ষেত্রেও অন্যজনের প্রতি পরিপূর্ণ উপেক্ষা প্রদর্শন করা জায়েয হবে না। সূরা আন-নিসার এ আয়াতে ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে না পারার আশংকার ক্ষেত্রে এক বিয়েতেই তৃপ্ত থাকার নির্দেশ এবং পরবতী আয়াতে “তোমরা কোন অবস্থাতেই একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সমতা রক্ষা করতে পারবে না” এ দু’আয়াতের মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে, এখানে মানুষের সাধ্যায়ত্ব ব্যাপারে স্ত্রীদের মধ্যে সমতা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় আয়াতে যা মানুষের সাধ্যের বাইরে অর্থাৎ আন্তরিক আকর্ষণের ব্যাপারে সমতা রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে। সুতরাং দু’টি আয়াতের মর্মে যেমন কোন বৈপরীত্ব নেই, তেমনি এ আয়াতের দ্বারা একাধিক বিবাহের অবৈধতাও প্রমাণিত হয় না। যদি আমরা এ আয়াতের শানে-নুযুলের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলছেন, একটি ইয়াতীম মেয়ে এক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে ছিল। লোকটি সে ইয়াতীম মেয়েটির সাথে সম্পদে অংশীদারও ছিল। সে তাকে তার সৌন্দর্য ও সম্পদের জন্য ভালবাসত। কিন্তু সে তাকে ইনসাফপূর্ণ মাহ্‌র দিতে রাযী হচ্ছিল না। তখন আল্লাহ্‌ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করে মাহ্‌র দানের ক্ষেত্রে ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থা কায়েম করার নির্দেশ দেন। ইয়াতীম হলেই তার মাহ্‌র কম হয়ে যাবে, এমনটি যেন না হয় সেদিকে গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দান করা হয়। [বুখারীঃ ২৪৯৪, ৪৫৭৪, ৫০৯২, মুসলিমঃ ৩০১৮]

[৫] এতে দু’টি শব্দ রয়েছে। একটি (اَدْنٰى) এটি (دُنُوٌّ) ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ হয় নিকটতর। দ্বিতীয় শব্দটি হচ্ছেঃ (لَاتَعُوْلُوْا) যা (عال) শব্দ হতে উৎপন্ন, অর্থ ঝুঁকে পড়া। এখানে শব্দটি অসংগতভাবে ঝুঁকে পড়া এবং দাম্পত্য জীবনে নির্যাতনের পথ অবলম্বন করা অর্থে ব্যবহৃত করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, এ আয়াতে তোমাদের যা বলা হল যে, সমতা বজায় রাখতে না পারার আশংকা থাকলে এক স্ত্রী নিয়েই সংসারযাত্রা নির্বাহ কর কিংবা শরীআতসম্মত ক্রীতদাসী নিয়ে সংসার কর; -এটা এমন এক পথ যা অবলম্বন করলে তোমরা যুলুম থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। বাড়াবাড়ি বা সীমালংঘনের সম্ভাবনাও দূর হবে। (تَعُوْلُوْا) শব্দের দ্বিতীয় আরেকটি অর্থ হতে পারে মিসকীন হয়ে যাওয়া। এর সপক্ষে সূরা আত-তাওবার ২৮ নং আয়াতে (عَيْلَةً) শব্দটি এসেছে। সেখানে শব্দটির অর্থ করা হয়েছে দারিদ্রতা। ইমাম শাফে’য়ী বলেন, এর অর্থ, যাতে তোমাদের পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি না পায়। [ফাতহুল কাদীর]

:
وَابْتَلُوا الْيَتَامَىٰ حَتَّىٰ إِذَا بَلَغُوا النِّكَاحَ فَإِنْ آنَسْتُمْ مِنْهُمْ رُشْدًا فَادْفَعُوا إِلَيْهِمْ أَمْوَالَهُمْ ۖ وَلَا تَأْكُلُوهَا إِسْرَافًا وَبِدَارًا أَنْ يَكْبَرُوا ۚ وَمَنْ كَانَ غَنِيًّا فَلْيَسْتَعْفِفْ ۖ وَمَنْ كَانَ فَقِيرًا فَلْيَأْكُلْ بِالْمَعْرُوفِ ۚ فَإِذَا دَفَعْتُمْ إِلَيْهِمْ أَمْوَالَهُمْ فَأَشْهِدُوا عَلَيْهِمْ ۚ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ حَسِيبًا

আর ইয়াতিমদেরকে যাচাই করবে [১] যে পর্যন্ত না তারা বিয়ের যোগ্য হয়; অতঃপর তাদের মধ্যে ভাল-মন্দ বিচারের জ্ঞান দেখতে পেলে [২] তাদের সম্পদ তাদেরকে ফিরিয়ে দাও [৩]। তারা বড় হয়ে যাবে বলে অপচয় করে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলো না। যে অভাবমুক্ত সে যেন নিবৃত্ত থাকে এবং যে বিত্তহীন সে যেন সংযত পরিমাণে ভোগ করে [৪]। অতঃপর তোমরা যখন তাদেরকে তাদের সম্পদ ফিরিয়ে দিবে তখন সাক্ষী রেখো। আর হিসেব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট।

ফুটনোট

[১] আয়াতে শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা ও যোগ্যতা যাচাই করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ বালেগ হওয়ার আগেই ছোট ছোট দায়িত্ব দিয়ে তাদের যোগ্যতা যাচাই করতে থাক, যে পর্যন্ত না তারা বিবাহের পর্যায়ে পৌঁছে অর্থাৎ বালেগ হয়। মোটকথা, বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে তাদের যোগ্যতা যাচাই করতে থাক এবং যখন দেখ যে, তারা দায়িত্ব বহন করার যোগ্য হয়ে উঠেছে, তখন তাদের সম্পদ তাদের হাতে বুঝিয়ে দাও। সারকথা হচ্ছে, শিশুরা বিশেষ প্রকৃতি ও জ্ঞানবুদ্ধির বিকাশের মাপকাঠিতে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। (এক) বালেগ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়, (দুই) বালেগ হওয়ার পরবর্তী সময়, (তিন) বালেগ হওয়ার আগেই জ্ঞান-বুদ্ধির যথেষ্ট বিকাশ। ইয়াতীম শিশুর অভিভাবকগণকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন তারা শিশুর লেখাপড়া ও জীবন গঠনের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অতঃপর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিষয়বুদ্ধির বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে ছোট ছোট কাজ কারবার ও লেন-দেনের দায়িত্ব অর্পণ করে তাদের পরীক্ষা করতে থাকেন।

[২] এ বাক্য দ্বারা কুরআনের এ নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে যে, ইয়াতীম শিশুর মধ্যে যে পর্যন্ত বুদ্ধি-বিবেচনার বিকাশ লক্ষ্য না কর, সে পর্যন্ত তাদের বিষয়-সম্পত্তি তাদের হাতে তুলে দিও না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ ‘বুদ্ধি-বিবেচনা’র সময়সীমা কি? কুরআনের অন্য কোন আয়াতেও এর কোন শেষ সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। এ জন্য কোন কোন ফিকহবিদ মত প্রকাশ করেছেন যে, যদি কোন ইয়াতীমের মধ্যে যথেষ্ট বয়স হওয়ার পরও বুদ্ধি-বিবেচনার লক্ষণাদি দেখা না যায়, তবে অভিভাবক তার হাতে বিষয়সম্পত্তি তুলে দিতে পারবে না। সমগ্র জীবন এ সম্পত্তি তার তত্ত্বাবধানে রাখতে হলেও না।

[৩] অর্থাৎ শিশু যখন বালেগ এবং বিয়ের যোগ্য হয়ে যায়, তখন তার অভিজ্ঞতা ও বিষয়বুদ্ধি পরিমাপ করতে হবে। যদি দেখা যায়, সে তার ভালমন্দ বুঝবার মত যথেষ্ট অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে, তখন তার বিষয়-সম্পত্তি তার হাতে তুলে দাও।

[৪] আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন ‘আস বলেন, এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমার কোন সম্পদ নেই। আমার তত্ত্বাবধানে ইয়াতীম আছে, তার সম্পদ রয়েছে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেনঃ তোমার ইয়াতীমের মাল থেকে তুমি খেতে পার, অপব্যয় ও অপচয় না করে, তার সম্পদকে তোমার সাথে না মিশিয়ে এবং তার সম্পদের বিনিময়ে তোমার সম্পদের হেফাজত না করে। [মুসনাদে আহমাদঃ ২/১৮৬, ২১৫, ২১৬, আবু দাউদঃ ২৮৭২]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, এ আয়াত ইয়াতীমের সম্পদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যদি কেউ ফকীর হয়, সে ইয়াতীমের সঠিক তত্ত্বাবধানের কারণে তা থেকে খেতে পারবে। [বুখারী: ৪৫৭৫; মুসলিম: ৩০১৯]

:
وَإِذَا حَضَرَ الْقِسْمَةَ أُولُو الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينُ فَارْزُقُوهُمْ مِنْهُ وَقُولُوا لَهُمْ قَوْلًا مَعْرُوفًا

আর সম্পত্তি বন্টনকালে আত্মীয়, ইয়াতীম এবং অভাবগ্রস্ত লোকদের উপস্থিত থাকলে তাদেরকে তা থেকে কিছু দিবে এবং তাদের সাথে সদালাপ করবে [১]।

ফুটনোট

[১] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এ আয়াত মুহকাম, এ আয়াত রহিত হয় নি। অর্থাৎ এর উপর আমল করতে হবে। [বুখারী ৪৫৭৬]

অন্য বর্ণনায় ইবন আব্বাস বলেন, আল্লাহ তা’আলা মুমিনগণকে তাদের মীরাস বন্টনের সময় আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, ইয়াতীমদের তত্ত্বাবধান এবং মিসকীনদের জন্য যদি মৃত ব্যক্তির কোন অসীয়ত থেকে থাকে, তবে সে অসীয়ত থেকে প্রদান করতে হবে। আর যদি অসীয়ত না থাকে, তবে তাদেরকে মীরাস থেকে কিছু পৌছাতে হবে। [তাবারী] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবদুর রহমান ইবন আবী বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মীরাস বন্টনের সময় -আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তখনও জীবিত- আব্দুর রহমানের সন্তান আবদুল্লাহ ঘরে ইয়াতীম, মিসকীন, আত্মীয়স্বজন সবাইকে তার পিতার মীরাস থেকে কিছু কিছু প্রদান করেন, এ হিসেবে যে, এখানে (الْقِسْمَةَ) শব্দের অর্থ, বন্টন। তারপর সেটা ইবন আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বললেন, ঠিক করে নি। কারণ এটা অসীয়ত করার প্রতি নির্দেশ। এ আয়াতটিতে অসীয়তের কথাই বলা হয়েছে। যখন মাইয়্যেত তার সম্পদের ব্যাপারে অসীয়ত করতে চাইবে সে যেন নিঃস্ব, ইয়াতীম স্বজনদের না ভুলে সে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] সে হিসেবে এটি মৃত্যুর আগেই সম্পদের মালিকের করণীয় নির্দেশ করছে।

: ১০
إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَىٰ ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا ۖ وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا

নিশ্চয় যারা ইয়াতীমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে তারা তো তাদের পেটে আগুনই খাচ্ছে; তারা অচিরেই জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে [১]।

ফুটনোট

[১] আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ পরিহার কর। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেগুলো কি? রাসূল বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, জাদু, অন্যায়ভাবে কোন প্রাণ সংহার করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতিমের সম্পদ গ্রাস করা, যুদ্ধের মাঠ থেকে পলায়ন করা এবং মুমিনা পবিত্ৰা নারীকে মিথ্যা অপবাদ দেয়া।’ [বুখারী: ২৭৬৬] সুতরাং ইয়াতিমের সম্পদ গ্রাস করার শাস্তি কুরআন ও হাদীস উভয়ের দ্বারাই প্রমাণিত।

: ৩৬
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ۖ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا

আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর ও কোন কিছুকে তাঁর শরীক করো না [১]; এবং পিতা-মাতা [২]; আত্মীয়-স্বজন [৩], ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত [৪], নিকট প্রতিবেশী [৫], দূর-প্রতিবেশী [৬], সঙ্গী-সাথী [৭], মুসাফির [৮] ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের [৯] প্রতি সদ্ব্যবহার করো। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে [১০]।

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদাত কর এবং ইবাদাতের বেলায় তাঁর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করো না। মু’আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে তার বাহনে বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় তিনি বললেন, তুমি কি জান, বান্দার উপর আল্লাহর কি হক? আমি বললামঃ আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ বান্দার উপর আল্লাহর হক হল, একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করা। তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক না করা। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো অনেক পথ চলার পর আবার বললেনঃ হে মুআয ইবন জাবাল! তুমি কি জান, বান্দা যদি এ কাজটি করে তাহলে আল্লাহর উপর বান্দার কি হক রয়েছে? আমি বললামঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহর উপর বান্দার হক হল, তাদেরকে শাস্তি না দেয়া। [বুখারীঃ ৬৫০০]

[২] আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তাওহীদের পর সমস্ত আপনজন-আত্মীয় ও সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পিতা-মাতার অধিকার সর্বাগ্রে। আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় ইবাদাত বন্দেগী ও হকসমূহের পর পরই পিতা-মাতার হক সম্পর্কিত বিবরণ দানের মাধ্যমে ইঙ্গিত করেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে সমস্ত নেয়ামত ও অনুগ্রহ একান্তই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে, কিন্তু বাহ্যিক উপকরণের দিক দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহর পরে মানুষের প্রতি সর্বাধিক ইহসান বা অনুগ্রহ থাকে পিতা-মাতার। সাধারণ উপকরণসমূহের মাঝে মানুষের অস্তিত্বের পিছনে পিতা-মাতাই বাহ্যিক কারণ। তাছাড়া জন্ম থেকে যৌবন প্রাপ্তি পর্যন্ত যে সমস্ত কঠিন ও বন্ধুর পথ ও স্তর রয়েছে, পিতা-মাতাই তাকে সেগুলোতে সাহায্য করেন এবং তার প্রতিপালন ও পরিবর্ধনের জামানতদার হয়ে থাকেন। সে জন্যই আল্লাহ তা’আলা অন্যান্য জায়গায়ও পিতামাতার হকসমূহকে তাঁর ইবাদাত ও আনুগত্যের সাথে যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ “আমার এবং তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর”। [সূরা লুকমান: ১৪]

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীসমূহে যেমন পিতা-মাতার আনুগত্য এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহারের তাকিদ রয়েছে, তেমনিভাবে তার সীমাহীন ফযীলত, মর্তবা ও সওয়াবের কথাও উল্লেখ রয়েছে। এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে”। [তিরমিযী: ১৮৯৯]

[৩] এখানে সমস্ত আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করার তাকিদ দেয়া হয়েছে। কুরআনুল কারীমের প্রসিদ্ধ এক আয়াতে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়শঃই বিভিন্ন ভাষণের পর তেলাওয়াত করতেন। তা হলো, “আল্লাহ সবার সাথে ন্যায় ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং নির্দেশ দিচ্ছেন আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করার জন্য”। [সূরা আন-নাহল: ৯০]

এতে সামর্থ্যানুযায়ী আত্মীয়-আপনজনদের কায়িক ও আর্থিক সেবা-যত্ন করা, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা এবং তাদের খবরা-খবর নেয়াও অন্তর্ভুক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সদকার মাল সাধারণ গরীব-মিসকীনকে দান করলে তাতে তো শুধু সদকার সওয়াবই পাওয়া যায়, অথচ তা যদি নিজের রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়-আপনজনকে দান করা হয়, তাহলে তাতে দুটি সওয়াব পাওয়া যায়। একটি হল সদকার সওয়াব এবং আরেকটি হল সেলায়ে-রেহমীর সওয়াব। [মুসনাদে আহমাদ ৪/২১৪, নাসায়ী: ২৫৮২] অর্থাৎ আত্মীয়তার হক আদায় করার সওয়াব।

[৪] অর্থাৎ লাওয়ারিশ তথা অনাথ শিশু এবং অসহায় মানুষের সাহায্য-সহযোগিতাও এমনি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী বিবেচনা করবে, যেমন আত্মীয়-আপনজনদের বেলায় করে থাক ।

[৫] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে আবু যর, যখন তরকারী রান্না করবে তখন তাতে বেশী পরিমাণে পানি দিও এবং এর দ্বারা তোমার পড়শীর খোজখবর নিও। [মুসলিমঃ ২৬২৫]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর ঈমান রাখে সে যেন তার পড়শীর সম্মান করে, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর ঈমান আনে সে যেন তার মেহমানের পুরস্কার দিয়ে তাকে সম্মানিত করে। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, মেহমানের পুরস্কার কি? তিনি বললেন, একদিন ও রাত্রি। আর মেহমান তিন দিন এর পরের যা সময় তাতে ব্যয় করা সদকাস্বরূপ। তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও শেষ দিনে উপর ঈমান আনে সে যেন ভাল বলে অথবা চুপ থাকে। [বুখারী: ৬০১৯]

অপর হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম সংগী হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সংগীগণ। আর আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম পড়শী হচ্ছেন ঐ পড়শী, যে তার পড়শীর জন্য উত্তম। [তিরমিযী: ১৯৪৪]

[৬] এ আয়াতে দু’রকমের প্রতিবেশীর কথা বলা হয়েছে। এ উভয় প্রকার প্রতিবেশীর বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, (جَارِذِى القُرْبٰى) বলতে সেসব প্রতিবেশীকে বোঝায়, যারা প্রতিবেশী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়ও বটে। এভাবে এতে দু’টি হক সমন্বিত হয়ে যায়। আর (وَالْجَارِ الْجُنُبِ) বলতে শুধু সে প্রতিবেশীকে বোঝায় যার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। আর সে জন্যই তার উল্লেখ করা হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে । [তাবারী] কোন কোন মনীষী বলেছেন, ‘জারে-যিলকোরবা’ এমন প্রতিবেশীকে বলা হয়, যে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত এবং মুসলিম। আর ‘জারে-জুনুব’ বলা হয় অমুসলিম প্রতিবেশীকে। কুরআনে ব্যবহৃত শব্দে অবশ্য এ সমুদয় সম্ভাব্যতাই বিদ্যমান। অবশ্য প্রতিবেশী হওয়া ছাড়াও যার অন্যান্য হক রয়েছে, অন্যান্য প্রতিবেশীদের তুলনায় তাকে মর্যাদাগত অগ্রাধিকার দিতে হবে।

[৭] যদিও এর শাব্দিক অর্থ হল সহকর্মী। এতে সেসব সফর সঙ্গীরাও অন্তর্ভুক্ত যারা রেল, জাহাজ, বাস, মোটর প্রভৃতিতে পাশাপাশি বসে ভ্রমণ করে এবং সে সমস্ত লোকও অন্তর্ভুক্ত যারা কোন সাধারণ বা বিশেষ বৈঠক বা অধিবেশনে আপনার সাথে উপবেশন করে থাকে। ইসলামী শরী’আত নিকটবর্তী ও দূরবর্তী স্থায়ী প্রতিবেশীদের অধিকার সংরক্ষণকে যেমন ওয়াজিব করে দিয়েছে, তেমনিভাবে সে ব্যক্তির সাহচর্যের অধিকার বা হককেও অপরিহার্য করে দিয়েছে, যে সামান্য সময়ের জন্য হলেও কোন মজলিস, বৈঠক অথবা সফরের সময় আপনার সমপর্যায়ে উপবেশন করে। তাদের মধ্যে মুসলিম, অমুসলিম, আত্মীয়, অনাত্মীয় সবাই সমান -সবার সাথেই সদ্ব্যবহার করার হেদায়াত করা হয়েছে। এর সর্বনিম্ন পর্যায় হচ্ছে এই যে, আপনার কোন কথায় বা কাজে যেন সে কোন রকম কষ্ট না পায়। এমন কোন কথা বলবেন না, যাতে সে মৰ্মাহত হতে পারে। এমন কোন আচরণ করবেন না, যাতে তার কষ্ট হতে পারে। যেমন, ধুমপান করে তার দিকে ধোঁয়া ছাড়া, পান খেয়ে তার দিকে পিক ফেলা এবং এমনভাবে বসা যাতে তার বসার জায়গা সংকুচিত হয়ে যায় প্রভৃতি। যানবাহনে অন্য কোন যাত্রী পাশে বসতে গেলে এ কথা ভাবা উচিত যে, এখানে তার ততটুকুই অধিকার রয়েছে যতটা রয়েছে আমার। কোন কোন তাফসীরকার বলেছেন, এমন প্রতিটি লোকই ‘সাহেবে-বিল-জাম্ব’-এর অন্তর্ভুক্ত যে কোন কাজে, কোন পেশায় বা কোন বিষয়ে আপনার সাথে জড়িত বা আপনার অংশীদার; তা শিল্প-শ্রমেই হোক অথবা অফিস-আদালতের চাকরিতেই হোক অথবা কোন সফরে বা স্থায়ী বসবাসেই হোক। [রুহুল মা’আনী]

[৮] আয়াতে এমন লোককে বোঝানো হয়েছে যে সফরের অবস্থায় আপনার নিকট এসে উপস্থিত হয় কিংবা আপনার মেহমান হয়ে যায়। যেহেতু এই অজানা-অচেনা লোকটির কোন আত্মীয় বা সম্পৰ্কীয় লোক এখানে উপস্থিত থাকে না, সেহেতু কুরআন ইসলামী তথা মানবীয় সম্পর্কের প্রেক্ষিতে তার হকও আপনার উপর অপরিহার্য বলে সাব্যস্ত করে দিয়েছে। তা হল, সামর্থ্য ও সাধ্যানুযায়ী তার সাথে সদ্ব্যবহার করা।

[৯] এতে অধিকারভুক্ত দাস-দাসীকে বোঝানো হয়েছে। তাদের ব্যাপারেও এ হক সাব্যস্ত ও অপরিহার্য করে দেয়া হয়েছে যে, তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। সাধ্যানুযায়ী তাদের খাওয়া পরার ব্যাপারে কার্পণ্য করবে না। তাছাড়া তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত কোন কাজ তাদের দ্বারা করাবে না। এখানে আয়াতের বাক্যগুলো যদিও সরাসরিভাবে অধিকারভুক্ত দাস-দাসীকেই বোঝাচ্ছে, কিন্তু কারণ-উপকরণের সামঞ্জস্য এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন বক্তব্যের ভিত্তিতে আলোচ্য নির্দেশ ও বিধি-বিধান দাস-দাসী, চাকর-চাকরানী ও অন্যান্য কর্মচারীর ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য। তাদের হকও একই রকম। নির্ধারিত বেতন-ভাতা, খানাপিনা প্রভৃতির ব্যাপারে কার্পণ্য বা বিলম্ব করা যাবে না এবং তাদের উপর সাধ্যাতীত কোন কাজও চাপানো যাবে না। যদি শরীআত মত তাদেরকে পরিচালনা করা হয় তবে তাদের যাবতীয় খরচও সদকার অন্তর্ভুক্ত। এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তুমি নিজে যা খাও তা তোমার জন্য সদকা এবং যা তোমার ছেলেকে খাওয়াও তাও তোমার জন্য সদকা, যা তোমার স্ত্রীকে খাওয়াও তাও তোমার জন্য সদকা। অনুরূপভাবে যা তোমার খাদেমকে খাওয়াও সেটাও তোমার জন্য সদকা হিসাবে গণ্য হবে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৪/১৩১]

অপর বর্ণনায় এসেছে, মা’রূর ইবন সা’য়ীদ বলেন, আমি আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহুর গায়ে একটি চাদর দেখলাম, অনুরূপ আরেকটি চাদর তার দাসের গায়ে দেখলাম। এ ব্যাপারে আমরা আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, একদিন এক লোককে গালি দিয়েছিলাম। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ ব্যাপারে গালি দিলে রাসূল আমাকে বললেন, তুমি কি তাকে তার মায়ের ব্যাপার উল্লেখ করে অপমান করলে? তারপর তিনি বললেন, “এরা তোমাদের ভাই, তোমাদের অনুগামী। আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে তোমাদের কর্তৃত্বাধীন করেছেন। অতএব যার কোন ভাই তার কর্তৃত্বাধীন থাকে, তবে সে যা খায় তা থেকে যেন তাকে খাওয়ায়, যা পরিধান করে তা থেকে যেন তাকে পরিধান করায়। তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত কোন দায়িত্ব তাদেরকে দিবে না, যদি সাধ্যের অতিরিক্ত কোন দায়িত্ব দাও তবে তাদেরকে সাহায্য কর।” [বুখারী: ২৫৪৫; মুসলিম: ১৬৬২]

[১০] আল্লাহ্‌ এমন লোককে পছন্দ করেন না, যে দাম্ভিক এবং নিজেকে অন্যের চাইতে বড় প্রতিপন্ন করে। আয়াতের এই শেষ বাক্যটি পূর্ববর্তী সমস্ত বক্তব্যের উপসংহার। কারণ, পূর্ববতী আটটি পর্যায়ে যে সমস্ত লোকের হক সম্পর্কে তাকীদ করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে সে সমস্ত লোকই শৈথিল্য প্রদর্শন করে যাদের মন-মানসিকতায় আত্মগৰ্ব, অহমিকা, তাকাববুর ও দাম্ভিকতা বিদ্যমান। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাহাবীকে ওসীয়ত করে বলেছেনঃ কাউকে গালি দিও না। সাহাবী বললেনঃ এরপর আমি কোন স্বাধীন, দাস, উট বা ছাগল কাউকেই গালি দেইনি। তিনি আরো বললেনঃ সামান্য কোন নেক কাজকেও হেয় করে দেখবে না যদিও তোমার কোন ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে কথা বলা হোক। আর তোমার কাপড়কে টাখনুর অর্ধেক পর্যন্ত উঠাবে, যদি তা করতে না চাও তবে দুই গিরা পর্যন্ত নামাতে পার। কাপড়কে ‘ইসবাল’ বা গিরার নীচে পরা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ কর। কেননা, এটাই অহংকারের চিহ্ন। আল্লাহ তা’আলা অহংকারীকে পছন্দ করেন না। যদি কোন লোক তোমাকে গালি দেয় অথবা তোমার কোন ক্রটি জানতে পেরে তা নিয়ে উপহাস করে, তুমি তার সেরকম কিছু জেনেও তাকে উপহাস করো না। কারণ, এর প্রতিফল তাকেই ভোগ করতে হবে। [আবু দাউদঃ ৪০৮৪, তিরমিযীঃ ২৭২২]

: ১২৭
وَيَسْتَفْتُونَكَ فِي النِّسَاءِ ۖ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِيهِنَّ وَمَا يُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ فِي يَتَامَى النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا تُؤْتُونَهُنَّ مَا كُتِبَ لَهُنَّ وَتَرْغَبُونَ أَنْ تَنْكِحُوهُنَّ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الْوِلْدَانِ وَأَنْ تَقُومُوا لِلْيَتَامَىٰ بِالْقِسْطِ ۚ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِهِ عَلِيمًا

আর লোকে আপনার কাছে নারীদের বিষয়ে ব্যবস্থা জানতে চায়। বলুন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তাদের সম্বন্ধে ব্যবস্থা জানাচ্ছেন এবং ইয়াতীম নারী সম্পর্কে যাদের প্রাপ্য তোমরা প্রদান কর না, অথচ তোমরা তাদেরকে বিয়ে করতে চাও [১] এবং অসহায় শিশুদের সম্বন্ধে ও ইয়াতীমদের প্রতি তোমাদের ন্যায় বিচার সম্পর্কে যা কিতাবে তোমাদেরকে শুনান হয়, তাও পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেন’। আর যে কোন সৎকাজ তোমরা কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা সম্পর্কে সবিশেষ জ্ঞানী।

ফুটনোট

ঊনিশতম রুকূ‘

[১] উরওয়া ইবন যুবাইর বলেন, তিনি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তখনকার সময় কারও কারও তত্ত্বাবধানে ইয়াতীম মেয়েরা থাকতো। তারা সে সব ইয়াতীম মেয়েদেরকে মাহ্‌র না দিয়েই বিয়ে করতে চাইতো। তখন এ সূরার প্রাথমিক আয়াতগুলো নাযিল হয়। কিন্তু এর বাইরেও কিছু ইয়াতিম থাকতো যাদের সম্পদ ও সৌন্দর্য ছিল না। তারা তাদেরকে বিয়ে করতে চাইতো না। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। [মুসলিম: ৩০১৮]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, জাহেলিয়াত যুগে কারও কাছে ইয়াতিম থাকলে সে তার উপর একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিত। যাতে করে অন্যরা তাকে বিয়ে করতে সমর্থ না হয়। তারপর যদি মেয়েটি সুন্দর হতো, তাহলে সে তাকে বিয়ে করত এবং তার সম্পদ নিয়ে নিত। পক্ষান্তরে অসুন্দর হলে সে তাকে আমৃত্যু বিয়ে দিতে বাঁধা দিত। এভাবে সে তার মৃত্যুর পর তার সম্পদের মালিক বনে যেত। এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সেটা নিষেধ করে দেন। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

: ১৫২
وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّىٰ يَبْلُغَ أَشُدَّهُ ۖ وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ ۖ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ۖ وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَىٰ ۖ وَبِعَهْدِ اللَّهِ أَوْفُوا ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ

আর ইয়াতীম বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত উত্তম ব্যবস্থা ছাড়া তোমরা ছাড়া তোমারা তার সম্পত্তির ধারে-কাছেও যাবে না [১] এবং পরিমাপ ও ওজন ন্যায্যভাবে পুরোপুরি দেবে [২]। আমরা কাউকেও তার সাধ্যের চেয়ে বেশী ভার অর্পণ করি না। আর যখন তোমারা কথা বলবে তখন ন্যায্য বলবে, স্বজনের সম্পর্কে হলেও [৩] এবং আল্লাহকে দেয়া অঙ্গীকার পূর্ণ করবে [৪]। এভাবে আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।

ফুটনোট

[১] ষষ্ঠ হারাম ইয়াতীমের ধন-সম্পদ অবৈধভাবে ভক্ষণ করাঃ

এ আয়াতে ইয়াতীমের ধন-সম্পদ যে ভক্ষণ করা হারাম, সে সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “ইয়াতীমের মালের কাছেও যেও না; কিন্তু উত্তম পন্থায়, যে পর্যন্ত না সে বলেগ হয়ে যায়”। এখানে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ইয়াতীম শিশুদের অভিভাবককে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, তারা যেন ইয়াতীমদের সম্পদকে আগুন মনে করে এবং অবৈধভাবে তা খাওয়া ও নেয়ার ব্যাপারে নিকটবতীও না হয়। অন্য এক আয়াতে অনুরূপ ভাষায়ই বলা হয়েছে যে, “যারা ইয়াতীমদের মাল অন্যায় ও অবৈধভাবে ভক্ষণ করে, তারা নিজেদের পেটে আগুণ ভর্তি করে। " [সূরা আন-নিসা:১০] তবে ইয়াতীমের মাল সংরক্ষণ করা এবং স্বভাবতঃ লোকসানের আশঙ্কা নেই- এরূপ কারবারে নিয়োগ করে তা বৃদ্ধি করা উত্তম ও জরুরী পন্থা। ইয়াতীমদের অভিভাবকদের এ পস্থা অবলম্বন করা উচিত। [কুরতুবী] আলোচ্য আয়াতে এরপর ইয়াতীমের মাল সংরক্ষণের সীমা বর্ণনা করা হয়েছে, “সে বয়োঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত”। অর্থাৎ বয়োঃপ্রাপ্ত হয়ে গেলে অভিভাবকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। অতঃপর তার মাল তার কাছে সমর্পণ করতে হবে। (اشُدَّ) শব্দের প্রকৃত অর্থ শক্তি। আলেমগণের মতে বয়োঃপ্রাপ্ত হলেই এর সূচনা হয়। বালক-বালিকার মধ্যে বয়োঃপ্রাপ্তির লক্ষণ দেখা দিলে, তাদের মধ্যে নিজের মালের রক্ষণা-বেক্ষণ এবং শুদ্ধ খাতে ব্যয় করার যোগ্যতা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। যোগ্যতা দেখলে বয়োঃপ্রাপ্তির সাথে সাথে তার ধন-সম্পদ তার হাতে সমর্পণ করতে হবে। [কুরতুবী]

[২] সপ্তম হারাম ওজন ও মাপে ক্রটি করাঃ

এ আয়াতে সপ্তম নির্দেশ ওজন ও মাপ ন্যায়ভাবে পূর্ণ করা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। ‘ন্যায়ভাবে’ বলার উদ্দেশ্য এই যে, যে ওজন করে দেবে, সে প্রতিপক্ষকে কম দেবে না এবং প্রতিপক্ষ নিজ প্রাপ্যের চাইতে বেশী নেবে না। দ্রব্য আদান-প্রদানে ওজন ও মাপে কম-বেশী করাকে কুরআন কঠোর হারাম সাব্যস্ত করেছে। যারা এর বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের জন্য সূরা আল-মুতাফফিফীনে কঠোর শাস্তিবাণী বর্ণিত হয়েছে। মুফাসসির আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ ‘ওজন ও মাপ এমন একটি কাজ যে, এতে অন্যায় আচরণ করে তোমাদের পূর্বে অনেক উম্মত আল্লাহর আযাবে পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে’। [কুরতুবী; ইবন কাসীর; আদ-দুররুল মানসূর] আলোচ্য আয়াতে এরপর বলা হয়েছে, “আমরা কোন ব্যক্তিকে তার সাধ্যাতিরিক্ত কাজের নির্দেশ দেই না।”

এর অর্থ এরূপও হতে পারে যে, সাধ্যমত পুরোপুরি ওজন করো, তারপরও যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে ওজনে কমবেশী হয়ে যায়, তবে তা মাফ। কেননা, এটা তার শক্তি ও সাধ্যের বাইরে। [ কুরতুবী ইবন কাসীর; সা’দী]

[৩] অষ্টম নির্দেশ ন্যায় ও সুবিচারের বিপরীত করা হারামঃ

বলা হয়েছে, “তোমরা যখন কথা বলবে, তখন ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে, যদি সে আত্মীয়ও হয়”। এখানে বিশেষ কোন কথার উল্লেখ নাই। তাই সাধারণ মুফাসসিরীনগণের মতে সব রকম কথাই এর অন্তর্ভুক্ত। কোন ব্যাপারে সাক্ষ্য হোক কিংবা বিচারকের ফয়সালা হোক অথবা পারস্পরিক বিভিন্ন প্রকার কথাবার্তাই হোক- সব ক্ষেত্রে, সর্বাবস্থায় ন্যায় ও সত্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে কথা বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। [কুরতুবী] মোকাদ্দমার সাক্ষ্য কিংবা ফয়সালার ক্ষেত্রে ন্যায় ও সত্য কায়েম রাখার অর্থ এই যে, ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে যা জানা আছে, নিজের পক্ষ থেকে কমবেশী না করে তা পরিস্কার বলে দেয়া- অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে কোন কথা না বলা এবং এতে কারো উপকার কিংবা কারো অপকারের ভ্রক্ষেপ না করা। মোকাদ্দমার ফয়সালার সাক্ষীদেরকে শরী’আতের নীতি অনুযায়ী যাচাই করার পর তাদের সাক্ষ্য ও অন্যান্য সূত্র দ্বারা যা প্রমাণিত হয়, তাই ফয়সালা করা। সাক্ষ্য ও ফয়সালায় কারো বন্ধুত্ব ও ভালবাসা এবং কারো শক্রতা ও বিরোধিতা সত্য বলার পথে অন্তরায় না হওয়া উচিত। আত্মীয়তা বা অনাত্মীয় যেই হোক না কেন ন্যায় ও সত্যকে কোন অবস্থাতেই হাতছাড়া না করা। [কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর; সা’দী; আইসারুত তাফাসীর, মুয়াসসার]

[৪] নবম নির্দেশঃ আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করাঃ

বলা হয়েছে, "আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ কর"। এ অঙ্গীকারের দাবী হল এই যে, পালনকর্তার কোন নির্দেশ অমান্য করা যাবে না। তিনি যে কাজের আদেশ দেন, তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি যে কাজে নিষেধ করেন, তার কাছেও যাওয়া যাবে না এবং সন্দেহযুক্ত কাজ থেকেও বাঁচতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার পুরোপুরি আনুগত্য করতে হবে। এছাড়া এর অর্থ কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত বিশেষ বিশেষ অঙ্গীকারও হতে পারে। যেমন আল্লাহ তা'আলা তাঁর রাসূলদের মুখে যে সমস্ত অঙ্গীকারের ঘোষণা দিয়েছেন সেগুলো পূর্ণ করা। আল্লাহ বলেন, “হে বনী আদম! আমি কি তোমাদের থেকে এ অঙ্গীকার নেইনি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব করো না, কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য শক্র? [সূরা ইয়াসীন ৬০] আরও বলেন, “আর তোমরা আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করো যখন পরস্পর অঙ্গীকার কর” [সূরা আন-নাহল: ৯১] অনুরূপভাবে মানুষের মধ্যকার পরস্পর যে সমস্ত অঙ্গীকার হয়ে থাকে সেগুলোই উদ্দেশ্য। [সা'দী] আল্লাহ তা'আলা বলেন, “আর প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূর্ণ করবে”। [সূরা আল-বাকারাহ: ১৭৭] মোটকথা, এ নবম নির্দেশটি গণনার দিক দিয়ে নবম হলেও স্বরূপের দিক দিয়ে শরী’আতের যাবতীয় আদেশ নিষেধের মধ্যে পরিব্যপ্ত।

: ৪১
وَاعْلَمُوا أَنَّمَا غَنِمْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللَّهِ وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ ۗ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

আর জেনে রাখ, যুদ্ধে যা তোমরা গনীমত হিসেবে লাভ করেছ ,তার এক-পঞ্চামাংশ আল্লাহ্‌র [১] , রাসূলের, রাসূলের স্বজনদের, ইয়াতীমদের, মিসকীনদের এবং সফরকারীদের [২] যদি তোমারা ঈমান রাখ আল্লাহ্‌তে এবং তাতে যা মীমাংসার দিন আমারা আমাদের বান্দার প্রতি নাযিল করেছিলাম [৩], যে দিন দু দল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল।আর আল্লাহ্‌ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।

ফুটনোট

[১] এ আয়াতে গনীমতের বিধান ও তার বন্টননীতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অভিধানে গনীমত বলা হয় সে সমস্ত মাল-সামানকে যা শক্রর নিকট থেকে লাভ করা হয়। শরীআতের পরিভাষা অনুযায়ী অমুসলিমদের নিকট থেকে যুদ্ধ-বিগ্রহে বিজয়ার্জনের মাধ্যমে যে মালামাল অর্জিত হয়, তাকেই বলা হয় ‘গনীমতী’ [ফাতহুল কাদীর] আর যা কিছু আপোষ, সন্ধি-সম্মতির মাধ্যমে অর্জিত হয়, তাকে বলা হয় ’ফাই’। [ইবন কাসীর] কুরআনুল কারামে এতদুভয় শব্দের মাধ্যমে (অর্থাৎ ‘গনীমত’ ও ‘ফাই’) এতদুভয় প্রকার মালামালের হুকুম-আহকাম তথা বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে সূরা আনফালের প্রথম আয়াতে এবং এ আয়াতে শুধুমাত্র গনীমতের মালামালের কথাই আলোচিত হয়েছে যা যুদ্ধকালে অমুসলিমদের কাছ থেকে লাভ হয়েছে। ‘ফাই’-এর আলোচনা সূরা হাশর-এ আসবে।

[২] এখানে জিহাদের পর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ গণীমতের হকদারদের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। সমস্ত সম্পদ পাঁচ ভাগে ভাগ করা হবে। এর চার ভাগ যোদ্ধাদের মধ্যে বন্টন করা হবে। আর বাকী এক পঞ্চমাংশ পাঁচভাগে ভাগ করা হবে। প্রথমভাগ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের। এ অংশ মুসলিমদের সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষনে ব্যয় হবে। দ্বিতীয়ভাগ রাসূলের স্বজনদের জন্য নির্ধারিত। তারা হলেন ঐ সমস্ত লোক যাদের উপর সদকা খাওয়া হারাম। অর্থাৎ বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব। কারণ তাদের দেখাশুনার দায়িত্ব রাসূলের ছিল। তিনি তার নবুওয়াতের কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকায় তাদের জন্য এ গণীমতের মাল থেকে দেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। তৃতীয়ভাগ ইয়াতিমদের জন্য
সুনির্দিষ্ট। চতুর্থভাগ ফকীর ও মিসকিনদের জন্য, আর পঞ্চম ভাগ মুসাফিরদের জন্য। [ইবন কাসীর] ইবন তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, পুরো এক পঞ্চমাংশই বর্তমানে ইমামের কর্তৃত্বে থাকবে। তিনি মুসলিমদের অবস্থা অনুযায়ী কল্যাণকর কাজে ব্যয় করবেন। [ইবন কাসীর] সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, গণীমতের মাল যদিও পূর্বে সূরা আনফালের প্রথম আয়াতে শুধু আল্লাহ ও তার রাসূলের বলা হয়েছে তবুও তা মূলতঃ মুসলিমদের মধ্যেই পুনরায় বন্টন হয়ে গেছে। রাসূল তার জন্য তার জীবদ্দশায় যা কিছু পেতেন তাও বর্তমানে সাধারণ জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হয়ে থাকে।

[৩] অর্থাৎ সে সাহায্য ও সহায়তা, যার বদৌলতে তোমরা জয়লাভ করেছ। [মুয়াসসার] এখানে মীমাংসার দিন বলে বদরের দিনকে বুঝানো হয়েছে। কারণ এ দিন তিনি হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করেছেন, ঈমানের কালেমাকে কুফরীর কালেমার উপর বিজয়ী করেছেন এবং তার দ্বীন, তার নবী ও অনুসারীদেরকে উপরে উঠিয়েছেন। [ইবন কাসীর]

১৭ : ৩৪
وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّىٰ يَبْلُغَ أَشُدَّهُ ۚ وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ ۖ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا

আর ইয়াতিম বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সদুপায়ে চাহারা টার সম্পত্তির ধারে-কাছেও যেও না এবং প্রতিশ্রুতি পালন করো; নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।
ফুটনোট

১৮ : ৮২
وَأَمَّا الْجِدَارُ فَكَانَ لِغُلَامَيْنِ يَتِيمَيْنِ فِي الْمَدِينَةِ وَكَانَ تَحْتَهُ كَنْزٌ لَهُمَا وَكَانَ أَبُوهُمَا صَالِحًا فَأَرَادَ رَبُّكَ أَنْ يَبْلُغَا أَشُدَّهُمَا وَيَسْتَخْرِجَا كَنْزَهُمَا رَحْمَةً مِنْ رَبِّكَ ۚ وَمَا فَعَلْتُهُ عَنْ أَمْرِي ۚ ذَٰلِكَ تَأْوِيلُ مَا لَمْ تَسْطِعْ عَلَيْهِ صَبْرًا

আর ঐ প্রাচীরটি—সেটি ছিল নগরবাসী দুই ইয়াতিম কিশোরের এবং এর নীচে আছে তাদের গুপ্তধন [১] আর তাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ [২]। কাজেই আপনার রব তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে ইচ্ছে করলেন যে, তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হোক এবং তারা তাদের ধনভাণ্ডার উদ্ধার করুক। আর আমি নিজ থেকে কিছু করিনি; আপনি যে বিষয়ে ধৈর্য ধারনে অপারগ হয়েছিলেন, এটাই তার ব্যাখ্যা [৩]।

ফুটনোট

[১] এখানে আল্লাহ্ তাআলা সে প্রাচীরের নীচে খনি আছে বলেছেন। এর অতিরিক্ত কোন তাফসীর করেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেও সহীহ কোন তাফসীর বর্ণিত হয়নি। তাই এ ব্যাপারে সঠিক কোন মতামত দেয়া যায় না। তবে কাতাদাহ রাহিমাহুল্লাহ থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, এখানে গচ্ছিত খনি বলতে সম্পদ বোঝানো হয়েছে। আর আয়াতের ভাষ্য থেকেও এ অর্থই বেশী সুস্পষ্ট। [দেখুন, তাবারী]

[২] এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, খাদির ‘আলাইহিস সালাম-এর মাধ্যমে ইয়াতীম বালকদের জন্য রক্ষিত গুপ্তধনের হেফাযত এজন্য করানো হয় যে, তাদের পিতা একজন সৎকর্মপরায়ণ আল্লাহর প্রিয় বান্দা ছিলেন। তাই আল্লাহ তা’আলা তার সন্তান-সন্ততির উপকারার্থে এ ব্যবস্থা করেন। [ইবন কাসীর]

[৩] খাদির ‘আলাইহিস সালাম জীবিত আছেন, না ওফাত হয়ে গেছেঃ এ বিষয়ের সাথে কুরআনে বর্ণিত ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই। তাই কুরআন ও হাদীসে স্পষ্টতঃ এ সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এ ব্যাপারে সর্বকালেই আলেমদের বিভিন্নরূপ মতামত পরিদৃষ্ট হয়েছে। যাদের মতে তিনি জীবিত আছেন, তাদের প্রমাণ হচ্ছে একটি বর্ণনা। যাতে বলা হয়েছেঃ যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাত হয়ে যায়, তখন সাদা-কালো দাড়িওয়ালা জনৈক ব্যক্তি আগমন করে এবং ভীড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে কান্নাকাটি করতে থাকে। এই আগন্তুক সাহাবায়ে কেরামের দিকে মুখ করে বলতে থাকেঃ আল্লাহর দরবারেই প্রত্যেক বিপদ থেকে সবর আছে, প্রত্যেক বিলুপ্ত বিষয়ের প্রতিদান আছে এবং তিনি প্রত্যেক ধ্বংসশীল বস্তুর স্থলাভিষিক্ত। তাই তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন কর এবং তার কাছেই আগ্রহ প্রকাশ কর। কেননা, যে ব্যক্তি বিপদের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়, সে-ই প্রকৃত বঞ্চিত। আগন্তুক উপরোক্ত বাক্য বলে বিদায় হয়ে গেলে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেনঃ ইনি খাদির ‘আলাইহিস সালাম। [মুস্তাদরাকঃ ৩/৫৯, ৬০] তবে বর্ণনাটি সম্পূর্ণ বানোয়াট।

পক্ষান্তরে যারা খাদির ‘আলাইহিস সালাম-এর জীবদ্দশা অস্বীকার করে, তাদের বড় প্রমাণ হচ্ছে
এক) আল্লাহ তা’আলার বাণীঃ “আমরা আপনার আগেও কোন মানুষকে অনন্ত জীবন দান করিনি”। [সূরা আল-আম্বিয়ঃ ৩৪] সুতরাং খাদির আলাইহিসসালামও অনন্ত জীবন লাভ করতে পারেন না। তিনি নিশ্চয়ই অন্যান্য মানুষের মত মারা গেছেন।

দুই) আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের শেষ দিকে এক রাতে আমাদেরকে নিয়ে এশার সালাত আদায় করেন। সালাত শেষে তিনি দাঁড়িয়ে যান এবং নিমোক্ত কথাগুলো বলেনঃ “তোমরা কি আজকের রাতটি লক্ষ্য করছ? এই রাত থেকে একশ’ বছর পর আজ যারা পৃথিবীতে আছে, তাদের কেউ জীবিত থাকবে না। ’ [মুসলিমঃ ২৫৩৭]

তিন) অনুরূপভাবে, খাদির ‘আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আমলে জীবিত থাকলে তার কাছে উপস্থিত হয়ে ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করা তার জন্য অপরিহার্য ছিল। কেননা, হাদীসে বলা হয়েছে “মূসা জীবিত থাকলে আমার অনুসরণ করা ছাড়া তারও গত্যন্তর ছিল না। ” [মুসনাদে আহমাদঃ ৩/৩৩৮] (কারণ, আমার আগমনের ফলে তার দ্বীন রহিত হয়ে গেছে। )

চার) বদরের প্রান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেনঃ “যদি আপনি এ ক্ষুদ্র দলটিকে ধ্বংস করেন তবে যমীনের বুকে আপনার ইবাদতকারী কেউ থাকবে না”। [মুসলিমঃ ১৭৬৩] এতে বোঝা যাচ্ছে যে, খাদির নামক কেউ জীবিত নেই।

এ সব দলীল-প্রমাণ দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে, খাদির ‘আলাইহিস সালাম জীবিত নেই। সুতরাং যারাই তার সাথে সাক্ষাতের দাবী করবে, তারাই মিথ্যার উপর রয়েছে। এটাও অসম্ভব নয় যে, শয়তান তাদেরকে খাদিরের রূপ ধরে বিভ্রান্ত করছে। কারণ, শয়তানের পক্ষে খাদিরের রূপ ধারণ করা অসম্ভব নয়। [বিস্তারিত দেখুন, ইবন কাসীর; ইবন তাইমিয়্যাহ, মাজমু ফাতাওয়া ৪/৩৩৭]

৫৯ :
مَا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَىٰ فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ ۚ وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

আল্লাহ্‌ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রাসূলকে 'ফায়’ হিসেবে যা কিছু দিয়েছেন তা আল্লাহ্‌র, রাসূলের, রাসূলের স্বজনদের, ইয়াতীমদের, মিসকীন ও পথচারীদের [১], যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান শুধু তাদের মধ্যেই ঐশ্বর্য আবর্তন না করে। রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমারা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ কর তা থেকে বিরত থাক [২] এবং তোমারা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ্‌ শাস্তি দানে কঠোর।

ফুটনোট

[১] أهل القرى বলে এ আয়াতে বনু নান্ধীর ও বনু কুরাইযা ইত্যাদি গোত্রকে বোঝানো হয়েছে। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীরা]

[২] এ আয়াত দ্বারা সাহাবায়ে কিরাম সবসময়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত যে অবশ্য পালনীয় তা বর্ণনা করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট এক মহিলা এসে বলল, শুনেছি আপনিউন্ধি আঁকা ও পরচুলা ব্যবহার করা থেকে নিষেধ করেন? এটা কি আপনি আল্লাহর কিতাবে পেয়েছেন? নাকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসে পেয়েছেন? তিনি বললেন, অবশ্যই হ্যাঁ, আমি সেটা আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাত সব জায়গায়ই পেয়েছি। মহিলা বলল, আমি তো আল্লাহর কিতাব ঘেটে শেষ করেছি কিন্তু কোথাও পাইনি। তিনি বললেন, তবে কি তুমি তাতে

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا

“রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাক” এটা পাওনি? সে বললঃ হ্যাঁ, তারপর ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, পরচুলা ব্যবহারকারিনী, উল্কি অংকনকারীনী, ভ্ৰ ব্লাককারীনীর প্রতি আল্লাহ লা'নত করেছেন। [দেখুন, বুখারী: ৪৮৮৬, ৪৮৮৭, মুসলিম: ২১২৫, আবুদাউদ: ৪১৬৯, তিরমিয়ী: ২৭৮২, নাসায়ী: ৫০৯৯, ইবনে মাজাহ: ১৯৮৯, মুসনাদে আহমাদ: ১/৪৩২]

অনুরূপভাবে ইবনে উমর ও ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম বলেন যে, “তারা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুব্বা, হানতাম, নাকীর ও মুযাফফাত, (এগুলো জাহেলী যুগের বিভিন্নপ্রকার মদ তৈরী করার পাত্ৰ বিশেষ) এ কয়েক প্রকার পাত্ৰ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তিলাওয়াত করলেন,

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا [মুসলিমঃ ১৯৯৭, আবু দাউদঃ ৩৬৯০, নাসায়ীঃ ৫৬৪৩]

৭৬ :
وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا

আর তারা মহব্বত থাকা সাপেক্ষে [১] অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে [২] খাবার দান করে [৩] ,

ফুটনোট

[১] অর্থাৎ জান্নাতীদের এসব নেয়ামত একারণেও যে, তারা দুনিয়াতে অভাবগ্ৰস্ত, এতীম ও বন্দীদেরকে আহার্য দান করত। অধিকাংশ তাফসীরকারকের মতে, এখানে حبه এর সর্বনাম দ্বারা طعام বা খাবার উদ্দেশ্য। অর্থাৎ খাদ্য অত্যন্ত প্রিয় ও আকর্ষণীয় হওয়া সত্ত্বেও এবং নিজেরাই খাদ্যের মুখাপেক্ষী হওয়া সত্ত্বেও নেক্কার লোকেরা তা অন্যদেরকে খাওয়ান। আবু সুলাইমান আদ-দারানী বলেন, حبه এর সর্বনাম দ্বারা الله তা‘আলাকেই উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা আল্লাহ্ তা‘আলার মহব্বতে এরূপ করে থাকে। পরবর্তী আয়াতাংশ ‘আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যেই তোমাদের খাওয়াচ্ছি’ এ অর্থকেই সমর্থন করে। [কুরতুবী; ইবন কাসীর]

[২] এ আয়াতে বন্দী বলতে কাফের হোক বা মুসলিম, যুদ্ধবন্দী হোক বা অপরাধের কারণে বন্দী হোক সব রকম বন্দীকে বুঝানো হয়েছে। বন্দী অবস্থায় তাদেরকে খাদ্য দেয়া, মুসলিম কিংবা অমুসলিম, সর্বাবস্থায় একজন অসহায় মানুষকে –যে তার খাবার সংগ্রহের জন্য নিজে কোন চেষ্টা করতে পারে না- খাবার দেয়া অতি বড় সওয়াবের কাজ। [দেখুন, কুরতুবী]

[৩] কোন গরীবকে খেতে দেয়া যদিও বড় নেকীর কাজ, কিন্তু কোন অভাবী মানুষের অন্যান্য অভাব পূরণ করাও একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে খেতে দেয়ার মতই নেক কাজ। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা কয়েদি মুক্ত কর, ক্ষুধার্তকে খাওয়াও এবং অসুস্থদের সুশ্রুষা কর” । [বুখারী: ৩০৪৬]

৮৯ : ১৭
كَلَّا ۖ بَلْ لَا تُكْرِمُونَ الْيَتِيمَ

কখনো নয় [১]। বরং [২] তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান কর না,

ফুটনোট

[১] পূর্ববর্তী ধারণা খণ্ডানোর জন্যই মহান আল্লাহ্ এ আয়াতে বলছেন যে, তোমাদের পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত ধারণাসমূহ সম্পূর্ণ ভ্ৰান্ত ও ভিত্তিহীন। দুনিয়াতে জীবনোপকরণের স্বাচ্ছন্দ সৎ ও আল্লাহ্র প্ৰিয়পাত্র হওয়ার আলামত নয়, তেমনি অভাব-অনটন ও দারিদ্র প্রত্যাখ্যাত ও লাঞ্ছিত হওয়ার দলীল নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাপার সম্পূর্ণ উল্টো হয়ে থাকে। কোন কোন নবী-রাসূল কঠিন কষ্ট ভোগ করেছেন আবার কোনও কোনও আল্লাহ্দ্রোহী আরাম-আয়েশে জীবন অতিবাহিত করে দিয়েছেন। [দেখুন, ইবন কাসীর]

[২] এখানে কাফের ও তাদের অনুসারী ফাসিকদের কয়েকটি মন্দ অভ্যাস সম্পর্কে সাবধান করা হচ্ছে। প্রথমেই বলা হয়েছে যে, তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান কর না। এখানে আসলে বলার উদ্দেশ্য এই যে, তোমরা ইয়াতীমদের প্রাপ্য আদায় কর না এবং তাদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার গ্রহণ করো না। [ফাতহুল কাদীর] রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “জন্নাতে আমি ও ইয়াতীমের তত্ত্বাবধানকারী এভাবে থাকবে” এটা বলে তিনি তার মধ্যমা ও তর্জনী আংগুলদ্বয় একসাথ করে দেখালেন। [বুখারী: ৬০০৫]

৯০ : ১৫
يَتِيمًا ذَا مَقْرَبَةٍ

ইয়াতীম আত্মীয়কে [১],

ফুটনোট

[১] এ ধরনের ইয়াতীমের হক সবচেয়ে বেশী। একদিকে সে ইয়াতীম, দ্বিতীয়ত সে তার নিকটাত্মীয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মিসকীনকে দান করা নিঃসন্দেহে একটি দান কিন্তু আত্মীয়দের দান করা দু’টি। দান ও আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। [মুসনাদে আহমাদ: ৪/২১৪, তিরমিয়ী: ৬৫৩]

৯৩ :
أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيمًا فَآوَىٰ

তিনি কি আপনাকে ইয়াতীম অবস্থায় পান নি? অতঃপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন [১] ;

ফুটনোট

[১] এখানে আল্লাহ্ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি কিছু নেয়ামতের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করেন। প্রথম নেয়ামত হচ্ছে, আমি আপনাকে পিতৃহীন পেয়েছি। আপনার জন্মের পূর্বেই পিতা ইন্তেকাল করেছিল এবং ছোট থাকতেই মা মারা যায়। অতঃপর আমি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি। অর্থাৎ প্রথমে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব, পরবর্তীতে পিতৃব্য আবু তালেব যত্নসহকারে আপনাকে লালন-পালন করতেন। [সা‘দী]

৯৩ :
فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ

কাজেই আপনি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হবেন না [১]।

ফুটনোট

[১] এ নেয়ামতগুলো উল্লেখ করার পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কয়েকটি বিষয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রথম নির্দেশ হচ্ছে, ইয়াতিমের সাথে কঠোর ব্যবহার করবেন না। অর্থাৎ আপনি কোন পিতৃহীনকে অসহায় ও বেওয়ারিশ মনে করে তার ধন-সম্পদ জবরদস্তিমূলকভাবে নিজ অধিকারভুক্ত করে নেবেন না। এর মাধ্যমে সকল উম্মতকেই ইয়াতীমের সাথে সহৃদয় ব্যবহার করার জোর আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং বেদনাদায়ক ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছেন। [বাদা’ই‘উত তাফসীর]

১০৭ :
فَذَٰلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ

সে তো সে-ই, যে ইয়াতীমকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয় [১]

ফুটনোট

[১] এখানে يدعُّ বলা হয়েছে। এর অর্থ, রূঢ়ভাবে তাড়ানো, কঠোরভাবে দূর করে দেয়া। এতিমদের প্রতি অসদাচরণ করা, তাদের প্রতি দয়া না করে কঠোরভাবে ধিক্কার ও যুলুম করা, তাদেরকে খাদ্য দান না করা এবং তাদের হক আদায় না করাই এখানে উদ্দেশ্য। [মুয়াসসার, ইবন কাসীর, তাবারী] জাহিলিয়াতের যুগে এতিম ও নারীদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হত আর বলা হত, যারা তীর-বর্শা নিক্ষেপ করে এবং তরবারী দিয়ে যুদ্ধ করে তারাই শুধু সম্পত্তি পাবে। কিন্তু পরবর্তীতে ইসলাম এ ধরনের প্রথা বাতিল করে দিয়েছে। [কুরতুবী]

0:00
0:00