[১] সেদিনের সে দাঁড়িপাল্লায় কোন অপরাধীর অপরাধ বাড়িয়ে দেয়া হবে না। আর কোন নেককারের নেক কমিয়ে দেয়া হবে না। [আদওয়াউল বায়ান] অন্য আয়াতেও আল্লাহ সেটা বলেছেন, “আর কেয়ামতের দিনে আমরা ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করব, সুতরাং কারো প্রতি কোন যুলুম করা হবে না এবং কাজ যদি শস্য দানা পরিমাণ ওজনেরও হয় তবুও তা আমরা উপস্থিত করব;" |সূরা আল-আম্বিয়া: ৪৭] তবে আল্লাহ্ তা'আলা কোন কোন নেক বান্দার আমলকে বহুগুণ বর্ধিত করবেন। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ অণু পরিমাণও যুলুম করেন না। আর কোন পুণ্য কাজ হলে আল্লাহ সেটাকে বহুগুণ বর্ধিত করেন এবং আল্লাহ তার কাছ থেকে মহাপুরস্কার প্রদান করেন।” [সূরা আন-নিসা:৪০] অনুরূপভাবে ‘হাদীসে বিতাকাহ’ নামে বিখ্যাত হাদীসেও দেখুন, [ইবন মাজাহঃ ৪৩০০; তিরমিযী ২১২৭] সেটা বর্ণিত হয়েছে।
[২] এ আয়াতে বলা হয়েছেঃ “সেদিন যে ভাল-মন্দ কাজকর্মের ওজন হবে তা সত্যসঠিকভাবেই হবে।” এতে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই। এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এতে মানুষ ধোঁকায় পড়তে পারে যে, যেসব বস্তু ভারী, সেগুলোর ওজন ও পরিমান হতে পারে। মানুষের ভাল-মন্দ কাজকর্ম কোন জড় পদার্থ নয় যে, এগুলোকে ওজন করা যেতে পারে। এমতাবস্থায় কাজকর্মের ওজন কিরূপে করা হবে? উত্তর এই যে, প্রথমতঃ আল্লাহ্ তা'আলা সর্বশক্তিমান। তিনি সব কিছুই করতে পারেন। অতএব, আমরা যা ওজন করতে পারি না আল্লাহ তা'আলাও তা ওজন করতে পারবেন, এটা বিচিত্র কিছু নয়। দ্বিতীয়তঃ আজকাল জগতে ওজন করার নতুন নতুন যন্ত্র আবিস্কার হয়েছে যাতে দাঁড়িপাল্লা, স্কেলকাঁটা ইত্যাদির কোন প্রায়োজন নেই। এসব নবাবিস্কৃত যন্ত্রের সাহায্যে আজকাল এমন বস্তুও ওজন করা যায়, যা ইতোপূর্বে ওজন করার কল্পনাও করা যেত না। আজকাল বাতাসের চাপ এবং বৈদ্যুতিক প্রবাহও ওজন করা যায়। এমনকি শীত-গ্রীষ্ম পর্যন্ত ওজন করা হয়। এগুলোর মিটারই এদের দাঁড়িপাল্লা। যদি আল্লাহ তা'আলা স্বীয় অসীম শক্তি-বলে মানুষের কাজকর্ম ওজন করে নেন, তবে এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই। হাদীসে রয়েছে যে, যদি কোন বান্দার ফরয কাজসমূহে কোন ক্রটি পাওয়া যায়, তবে রাববুল আলামীন বলবেনঃ দেখ, তার নফল কাজও আছে কি না। নফল কাজ থাকলে ফরযের ক্রটি নফল দ্বারা পূরণ করা হবে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৪/৬৫]
আমলের ওজন পদ্ধতিঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ পাখার সমানও হবে না। এ কথার সমর্থনে কুরআনুল কারীমের এ আয়াত পাঠ করলেন। "
(فَلَا نُقِيْمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيٰمَةِ وَزْنًا)
অর্থাৎ কেয়ামতের দিন আমি তাদের কোন ওজন স্থির করবো না ’ [বুখারীঃ ৪৪৫২, মুসলিমঃ ২৭৮৫] আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রশংসায় বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তার পা দুটি বাহ্যতঃ যতই সরু হোক, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, সেই সত্তার কসম, কেয়ামতের দাড়িপাল্লায় তার ওজন ওহুদ পর্বতের চাইতেও বেশী হবে। [মুসনাদে আহমাদ: ১/৪২০] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘দুটি বাক্য উচ্চারণের দিক দিয়ে খুবই হাল্কা; কিন্তু দাঁড়িপাল্লায় অত্যন্ত ভারী এবং আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়। বাক্য দুটি হচ্ছে, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’, ‘সুবহানাল্লাহিল আযীম'। [বুখারীঃ ৭৫৬৩] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেনঃ ‘সুবহানাল্লাহ’ বললে আমলের দাড়িপাল্লার অর্ধেক ভরে যায় আর ‘আলহামদুলিল্লাহ' বললে বাকী অর্ধেক পূর্ণ হয়ে যায়। [ মুসনাদে আহমাদঃ ৪/২৬০, ৫/৩৬৫; সুনান দারমীঃ ৬৫৩] অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘আমলের ওজনের বেলায় কোন আমলই সচ্চরিত্রতার সমান ভারী হবে না। [আবু দাউদঃ ৪৭৯৯; তিরমিয়ীঃ ২০০৩] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি জানাযার সাথে কবরস্থান পর্যন্ত যায়, তার আমলের ওজনে দু'টি কিরাত রেখে দেয়া হবে” [বুখারীঃ ১২৬১]। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, এই কিরাতের ওজন হবে ওহুদ পাহাড়ের সমান। [মুসলিমঃ ৬৫৪] কেয়ামতে আমলের ওজন সম্পর্কে এ ধরণের বহু হাদীস রয়েছে।
[৩] মানুষের জীবনের সমগ্র কার্যাবলী দু’টি অংশে বিভক্ত হবে। একটি ইতিবাচক বা সৎকাজ এবং অন্যটি নেতিবাচক বা অসৎকাজ। ইতিবাচক অংশের অন্তর্ভুক্ত হবে সত্যকে জানা ও মেনে নেয়া এবং সত্যের অনুসরণ করে সত্যের খাতিরে কাজ করা। আখেরাতে এটিই হবে ওজনদার, ভারী ও মূল্যবান। আর সে মূল্যবান কাজের ফলাফলও মূল্যবান হবে। এ আয়াতে তা উল্লেখ না হলেও অন্য আয়াতে সেটা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “অতঃপর যার পাল্লাসমূহ ভারী হবে, সে তো থাকবে সন্তোষজনক জীবনে " [সূরা আল-কারি'আহ:৬-৭] অর্থাৎ জান্নাতে। অন্যদিকে সত্য থেকে গাফিল হয়ে অথবা সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে মানুষ নিজের নফস-প্রবৃত্তি বা অন্য মানুষের ও শয়তানের অনুসরণ করে অসত্য পথে যা কিছুই করে, তা সবই নেতিবাচক অংশে স্থান লাভ করবে। আর এ নেতিবাচক অংশটি কেবল যে মূল্যহীন হবে তাই নয়, বরং এটি মানুষের ইতিবাচক অংশের মর্যাদাও কমিয়ে দেবে। কাজেই মানুষের জীবনের সমুদয় কার্যাবলীর ভাল অংশ যদি তার মন্দ অংশের ওপর বিজয় লাভ করে এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে অনেক কিছু দেবার পরও তার হিসেবে কিছু না কিছু অবশিষ্ট থাকে, তবেই আখেরাতে তার সাফল্য লাভ করা সম্ভব।
[১] এখানে ক্ষতি বলতে কি তা বলা হয়নি। অন্য আয়াতে সেটা স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “আর যার পাল্লাসমূহ হালকা হবে, তার স্থান হবে হা-ওয়িয়াহ’, আর আপনাকে কিসে জানাবে সেটা কী? অত্যন্ত উত্তপ্ত আগুন" [সূরা আল-কারি'আহ: ৮-১১] আরও বলেন, “আর যাদের পাল্লা হালকা হবে তারাই নিজেদের ক্ষতি করেছে; তারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে। আগুন তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে এবং তারা সেখানে থাকবে বীভৎস চেহারায়" [সূরা আল-মুমিনুন: ১০৩-১০৪]
[১] লক্ষণীয় যে, এখানে موازين শব্দটি ميزان শব্দের বহুবচন। [কুরতুবী] অর্থ ওজনের যন্ত্র তথা দাঁড়িপাল্লা। আয়াতের অর্থ, দাঁড়িপাল্লাসমূহ স্থাপন করা হবে। এখন প্রশ্ন হলো, মানদন্ড কি একটি না বহু? এখানে আয়াতে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে দেখে কোন কোন তফসীরবিদ বলেন যে, আমল ওজন করার জন্য অনেকগুলো দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। আমলের শ্রেণী অনুসারে অনেক দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। অথবা, প্রত্যেকের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন দাঁড়িপাল্লা হবে। আবার এটাও হতে পারে যে, একই মীযানকে বহু হিসেবে দেখানো হয়েছে। [কুরতুবী]
কিন্তু অধিকাংশ আলেমগণের মতে, দাঁড়িপাল্লা একটিই হবে। যার থাকবে দু'টি পাল্লা। যে দু'টি পাল্লা সবাই দেখতে পাবে, অনুভব করতে পারবে। তবে বহুবচনে ব্যক্ত করার কারণ হয়ত এটাই যে, মীযানের পাল্লাতে যেমনিভাবে বান্দার আমলনামা ওজন করা হবে তেমনিভাবে বান্দার আমলকেও সরাসরি ওজন করা হবে এমনকি বান্দাকেও ওজন করা হবে। সে হিসেবে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। [শারহুত তাহাভীয়্যাহ]
বান্দার আমলনামা ওজন করা হবে তার প্রমাণঃ হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহ আমার উম্মতের মধ্যে একলোককে কেয়ামতের দিন সমস্ত সৃষ্টির সামনে পৃথক করে একান্তে ডেকে তার জন্য ৯৯ টি দপ্তর বের করবেন যার প্রত্যেকটি চোখ যতদুর যায় তত লম্বা হবে। তারপর তাকে বলবেনঃ “তুমি কি এগুলো অস্বীকার করা? আমার রক্ষণাবেক্ষণকারী লেখক ফেরেশতাগণ কি তোমার উপর অত্যাচার করেছে? সে বলবেঃ না, হে প্ৰভু! তারপর আল্লাহ বলবেনঃ তোমার কি কোন ওজর বা সৎকর্ম আছে? লোকটি তখন হতভম্ব হয়ে গিয়ে বলবেঃ না, হে প্ৰভু! তখন আল্লাহ বলবেনঃ অবশ্যই তোমার একটি সৎকর্ম আছে, তোমার উপর আজ কোন যুলুম করা হবে না। তারপর তার জন্য একটি কার্ড বের করা হবে যাতে আছেঃ
أَشْهَدُأن لَّا إلٰه إلّا اللّٰهٗ، وأَنَّ مُحَمّدًا عَبْدُه وَ رَسُلُه
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন হক্ক ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। ” তারপর আল্লাহ বলবেনঃ সেটা নিয়ে আস। তখন লোকটি বলবেঃ হে প্ৰভু! ঐ সমস্ত দপ্তরের বিপরীতে এ কার্ড কি ভূমিকা রাখতে পারে? তখন আল্লাহ বলবেনঃ তোমার উপর যুলুম করা হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তারপর সে সমস্ত দপ্তর এক পাল্লায় এবং কার্ডটি আরেক পাল্লায় রাখা হবে। রাসূল বললেনঃ আর তাতেই সমস্ত দপ্তর উপরে উঠে যাবে এবং কার্ডটি ভারী হয়ে যাবে। আল্লাহর নামের বিপরীতে কোন কিছু ভারী হতে পারে না। ” [তিরমিয়ীঃ ২৬৩৯, ইবনে মাজাহঃ ৪৩০০] এ হাদীস দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, বান্দার আমলনামা ওজন করা হবে।
বান্দার আমলই সরাসরি ওজন করার প্রমাণঃ হাদীসে এসেছেঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “দুটি বাক্য এমন যা দয়াময়ের কাছে প্রিয়, জিহবার উপর হাল্কা, মীযানের মধ্যে ভারী, আর তা হলোঃ সুবাহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি (আল্লাহর পবিত্ৰতা ঘোষণা করছি তাঁর প্রশংসা সহকারে), "সুবহানাল্লাহিল 'আজীম' (মহান আল্লাহ কতই না পবিত্র)”। [বুখারীঃ ৭৫৬৩, মুসলিমঃ ২৬৯৪]
স্বয়ং আমলকারীকেও ওজন করা হবেঃ তার স্বপক্ষে প্রমাণ আল্লাহর বাণীঃ “সুতরাং আমরা তাদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন ওজন স্থির করব না”। [সূরা আল-কাহাফঃ ১০৫] অন্য এক হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘আরাক’ গাছে উঠলেন, তিনি ছিলেন সরু গোড়ালী বিশিষ্ট মানুষ, ফলে বাতাস তাকে নাড়াচ্ছিল তাতে উপস্থিত লোকেরা হেসে উঠল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেনঃ “তোমরা হাসছ কেন?” তারা বললঃ হে আল্লাহর নবী! তার সরু গোড়ালীর কারণে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, এ দু'টি মীযানের উপর উহুদ পাহাড়ের চেয়েও বেশী ভারী”। [মুসনাদে আহমাদঃ ১/৪২০-৪:২১, মুস্তাদরাক ৩/৩১৭]